নতুন মাত্রা পত্রিকার অনলাইন ভার্সন (পরীক্ষামূলক সম্প্রচার)

 ঢাকা      শুক্রবার ২৯শে সেপ্টেম্বর, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ | ১৪ই আশ্বিন, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

বাবার শাসনের একটা স্মৃতি খুব মনে পড়ে:পাপন ঘোষ

বার্তা সম্পাদক

প্রকাশিত: ৭:২৪ অপরাহ্ণ , ১৯ জুন ২০২০, শুক্রবার , পোষ্ট করা হয়েছে 3 years আগে

পাপন ঘোষ : খুব সম্ভব তখন আমি ক্লাস সেভেনে, সেদিন ঘুম থেকে ইচ্ছা করেই দেরী করে উঠেছি,যদিও বাবা ভোরে কয়েক দফা ডেকে বাজারে গেছেন। আর মা চেচাঁমেচিঁ করে কানের পর্দা ফাটিয়ে দিলেও আমি ওনার ডাকে সারা দেয়ার পাত্র না,তারপরেও কিছুক্ষণ বৃথা চেষ্টা করে পরাজয় স্বীকার করে রান্না ঘরে চলে গেছেন।তাছাড়া গত রাতে শরীরটা একটু খারাপ ছিল সেই অযুহাতে হলেও অংক প্রাইভেটটা ফাঁকি দেওয়ায় যায়।

কি সব উপপাদ্য মুখস্ত করতে দিছে পুরণজিৎ স্যার,সব মাথার উপর দিয়ে যায়।না দিতে পারলে উত্তম মধ্যম নিশ্চিত,তাই তো শরীর খারাপের ছুতোয় প্রাইভেট মিস দেয়া।
.
ব্রাশ হাতে চোখ কচলাতে কচলাতে গেলাম নদীর পাড়ে হাটতে।বাড়ি থেকে মিনিট দুইয়েকের পথ নদীর পাড়।মেঘনার ছোট্ট আর শান্ত মেয়ে ‘লঙ্গন’ নদী। অবশ্য বর্ষায় যখন যৌবন ফিরে পায় তখন শান্ত মেয়ে আর শান্ত থাকেনা।
কলমির বেড়া দিয়ে ঢালু জমির পলিভরা মাটিতে মৌসুমী শাক-সবজি চাষ করে অনেকেই।

দুটো কলমি ফুল সহ আস্ত একটা ঢাল ভেঙ্গে বা হাতে ঘুরাতে ঘুরাতে গেলাম বড় ঘাটের দিকে। একটু এগোতেই লক্ষ করলাম সামনের খানিকটা ঢালু জায়গা জুড়ে ক্রিকেট খেলার মস্ত আয়োজন চলছে,কেউ খবর দেয় নি বলে খুব রাগ ওঠছিলো।

কিছুক্ষণ বসে থাকার পর খেলার সুযোগ পেলাম,ক্রিকেট খেলা দেখলে হুশ থাকত না তখন।আমাদের পাড়ার কয়েকটা সমবয়সী ছেলেপুলে লুকিয়ে বিড়ি,সিগারেট টানতো, এইগুলা নাকি মারাত্মক নেশা, আর আমাদের ছিল তখন ক্রিকেটের নেশা। অবশ্য দামী ব্যাটের পরিবর্তে বরাবরই আমরা তক্তা কিংবা নৌকার পাটাতন ব্যবহার করেছি আর স্ট্যাম্প বলতে কলমির একটু মোটা ডাল।

যাইহোক খেলছি তো খেলছিই,খানিক্ষণ বাদেই মা ছোট ভাইটাকে দিয়ে খবর পাঠিয়েছে তাড়াতাড়ি স্নান সেরে বাড়িতে যাওয়ার জন্য। কে শুনে কার কথা, ওল্টো তাকে গালি দিয়ে বাড়িত পাঠিয়েছি। এদিকে কখন যে স্কুলে যাওয়ার সময় চলে গেছে তার ইয়ত্তা নেই। সূর্য মাথার উপরে তা ও খেলা শেষ হয়না, এর মধ্যেই কয়েক দফা কাক-স্নান হয়ে গেছে নদী থেকে বল আনার নিমিত্তে।খিদা ও সমানে বাড়ছে কিন্তু খেলার নেশার কাছে তাহা নিতান্তই তুচ্ছ।
.
নদীর একদম কিনারায় দাড়িয়ে ফিল্ডিং করছি, পায়ে কাদা লেগে যাচ্ছেতাই অবস্থা,কাদার রঙ আর আঙুলের রঙের খুব একটা পার্থক্য খোজে পাওয়া যাবেনা। হঠাৎ দক্ষিণ দিকে দৃষ্টি যেতেই লক্ষ করলাম নদীর পাড়ের ঢালু পথটা দিয়ে একটা লোক বড় বড় কদম ফেলে হনহনিয়ে এদিকে আসছে,হাতে একটা কলমির ডাল। এ তো দেখি বাবা!
“জমিদার তরে পাইয়া লই রে,হাত-পাওডি গুরা কইরা বাইত বাইন্দা রাখমু”
– ইয় বাবু আমি খালি আইছি….আমতা আমতা করতে করতে পেছন ফেরে সোজা দৌড়।
– অই খারা কইতাছি,কু** বাচ্চা আজকা তর একদিন কি আমার একদিন।

আমার সাথে চোখাচোখি হবার পর পায়ের গতি সমানে বৃদ্ধি পাচ্ছে। চোখ দুটো অগ্নিশর্মা, আজকে বুঝি রেহাই নেই! জেল পলাতক আসামী যেমন পুলিশ দেখলে দৌড় শুরু করে আমিও সেরকম দৌড় শুরু করলাম আর মনে মনে সবচাইতে নিরাপদ আশ্রয়স্থলের সন্ধান করতে লাগলাম কিন্তু সমস্যা হচ্ছে বাবা তো পেছন ছাড়ছে না, মহাভারতে জয়দ্রথকে যে বূহ্য করে লুকিয়ে রাখা হয়েছিলো সেখানে গেলেও মনেহয় বাবা গান্ডীবধারী অর্জুনের মতো আমার কাছে পৌঁছে যাবে।
.
বড় ঘাট থেকে খালের পাড় দিয়ে ঠাকুর বাড়ির চিপা-পথ দিয়ে বাড়িতে যাওয়ার একটা বিকল্প রাস্তা আছে, সেই রাস্তাটাকে উদ্দেশ্য করে দৌড়াতে লাগলাম। বাবা ও সমানে পেছন পেছন দৌড়াচ্ছে। ঠাকুর বাড়ির রাস্তাটা বেশ ঝোপঝাড়ে পূর্ণ,প্রস্থে এক ফুটের বেশি হবেনা,দেবদারুর শাখামুল মাটি ভেদ করে পথে অনিয়ত ভাবে ছড়িয়ে আছে, সতর্কতা অবলম্বন না করলে ধাক্কা খেয়ে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে,তাছাড়া রাস্তাটা সবসময় শুনশান থাকে,একদম জনমানবশূন্য।এমনকি দিনের বেলায় রাস্তাটা দিয়ে একা গেলে ভয় করে কিন্তু সেই সময় এই তুচ্ছ ভয়কে জয় করে দৌড়াচ্ছি আমি। এক লাফে কেওয়া গাছের বেড়া ডিঙিয়ে পেছনের দরজা দিয়ে সোজা ‘সুন্দর দিদা’দের ঘরে।

ভাগ্যিস পেছনের দরজাটা খোলা ছিল। অবশ্য কয়েকটা কেওয়া কাঁটা পায়ের তালুতে বিধেঁ যন্ত্রণা করছে তবে সে যন্ত্রণা নিতান্তই তুচ্ছ নিরাপদ আশ্র্যয়ের শান্তির তুলনায়।
.
‘সুন্দর দিদা’ নামের সঠিক ইতিহাস আমার মনে নেই। হয়তো অন্য দিদাদের তুলনায় ওনি দেখতে সুন্দর ছিলেন বলে কিংবা মায়ের কাছ থেকে শিখেছি এই ডাকটা। যাইহোক দিদার সামনে বাবা আমাকে কিছু করতে না পারলেও মারাত্মক রেগে আছে যে সেটা রক্তিম চোখ দুইটা দেখলেই বুঝা যায়। ব্যর্থ হয়ে বাবা চলে গেলো, এদিকে আমি স্নান করে দিদার কাছেই উদরপূর্তি করে সারাদিন ওনাদের ঘরেই থাকলাম।
.
মা কয়েকবার এসেছিলো আমাকে ঘরে নিয়ে যাওয়ার জন্য কিন্তু আমি ভয়ে যাই নি। রাতের খাবারের সময় মা এসে বললো বাবা নাকি ভাত সামনে নিয়ে বসে আছে, এদিকে আমার আবার রাতের খাবার বাবার সাথে বসে না খেলে তৃপ্তি হয়না।

খানিকটা ভয় আর সংকোচ নিয়েই ঘরে গেলাম, পিড়ি পেতে বসতেই বাবা আমার মুখে ভাত তুলে দিতে দিতে বলল,
“তরে ছাড়া কি খাওন পেটের ভিতরে যায়, ইস্কুল বাদ দিয়া সারাদিন মাঠে পইরা থাকলে মানুষ হইবি কেম্নে?”
– আর যাইতাম না(মাথা নিচু করে)
– যাও ঘুমাই থাকো গিয়া, আজকা আর পড়ন লাগত না

সেদিন রাতে কারেন্ট ছিল না, অবশ্য কারেন্ট না থাকলে আমার সুবিধা বেশি।সিলিং ফ্যানের বিরক্তিকর আওয়াজ আর এক তরফা বাতাসের তুলনায় বাবার হাতপাখার মৃদু-মন্দ বাতাসে বেশ আরামের।
সকালে ঘুম থেকে ওঠে মায়ের কাছে জানতে পারলাম সেদিন নাকি বাবা কিছুই মুখে তুলেন নি, আমাকে খাওয়ানোর পর নিজে খেয়েছে। কথা শুনে ভেতরটা ক্যামন জানি মোচর দিয়ে ওঠলো,হয়তো অপরাধবোধে।
.
এ যাবৎকালে বাবার শাসনের এই একটা স্মৃতি ই খুব মনে পড়ে,কারণ বাবা কখনো সেই অর্থে আমাকে মারধোর করে শাসন করেনি। খুব বেশি অন্যায় করলে দু’চারটা ধমক আর চোখ রাঙানোই আমার জন্য যথেষ্ট ছিল।

একটা মানুষ তার সন্তানকে কতটুকু ভালোবাসতে পারে,কতটা সেক্রিফাইস করতে পারে তা বাবা’কে না হারালে হয়তো কোনোদিন বুঝতাম না।মানুষটা সারাটা জীবন শুধু ত্যাগস্বীকার করেই গেছেন, অথচ সন্তান হিসেবে নূন্যতম দায়িত্বটুকু আমি পালন করতে পারিনি।

আজ বাবার তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকী, যেখানেই থাকুক না কেন ঈশ্বর যেন মানুষটাকে শান্তিতে রাখেন, এই প্রার্থনাটুকু ছাড়া কিছু করার সামার্থ্য যে এই অধমের নেই।

আপনার মন্তব্য লিখুন

আর্কাইভ

September 2023
M T W T F S S
« Aug    
 123
45678910
11121314151617
18192021222324
252627282930  
আরও পড়ুন
অনুবাদ করুন »