নতুন মাত্রা পত্রিকার অনলাইন ভার্সন (পরীক্ষামূলক সম্প্রচার)

 ঢাকা      শুক্রবার ২৯শে সেপ্টেম্বর, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ | ১৪ই আশ্বিন, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

ভালবাসা—–মোঃ মনিরুজ্জামান

বার্তা সম্পাদক

প্রকাশিত: ৩:৩২ অপরাহ্ণ , ৬ মে ২০২০, বুধবার , পোষ্ট করা হয়েছে 3 years আগে

সালটা মনে হয় ২০১৩ কি ১৪। আমি তখন ব্রাহ্মন বাড়িয়ার এসপি। সিনিয়র পুলিশ অফিসারদের মূল কাজ হল, তদারকি বা সুপার ভিশন । তা সে মামলা, ইউনিটই, অফিস বা ফাইলপত্র যাইেহোকনা কেন। পুলিশ সুপারের কন্ট্রোলরুমে, প্রতিদিন সকালে সকল থানা ও ইউনিট থেকে মর্নিং রিপোর্ট আসে। ফোর্সের বিবরন, ঘটনার বিবরন, বিগত ২৪ ঘন্টার কার্য্যক্রম, আসামী গ্রেফতার, উদ্ধার, ওয়ারেন্ট তামিল মামলা রুজু ইত্যাদি সবই সেখানে থাকে।

তার সাথে রুজুকৃত মামলা সহ অন্যান্য বিবরন, যা মূলত ষ্টাফরা পুটআপ ফাইলে অফিসারদের নিকট সকালেই উপস্থাপন করে। এসপি সাহেব মর্নিং রিপোর্ট বা পুটআপ ফাইল দেখে অফিসারদেরকে এনডোর্স করেন কে কি করবে ইত্যাদি ইত্যাদি। পুট আপ ফাইলের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হল বিগত ২৪ ঘন্টায় রুজুকৃত মামলার বিবরন বা বিগত ২৪ ঘন্টায় জমা হওয়া পুলিশ রিপোর্ট সমূহ। রুজুকৃত মামলা পর্য্যালোচনা করে এসপি সিদ্ধান্ত দেন কোন মামলা তিনি নিজে দেখবেন এবং কোন মামলা এডিশনাল এসপি বা সার্কেল এসপি দেখবে।

খুন, ডাকাতি ধর্ষনসহ গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি খাতের মামলা এসপি সাহেবকে নিজে বা ক্ষেত্রমতে একজন এডিশনাল এসপি কে দেখতে হয়। দেখা মানে ঘটনাস্থল পরিদর্শন, বাদী এবং মামলা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের সাথে আলাপচারিতা এবং তদন্তকারী অফিসারকে পরামর্শ প্রদান ইত্যাদি। সার্কেল এএসপির দায়ীত্ব সকল মামলা সুপারভাইজ করা। সাধারনত মারামারি, জমি জমা বা ছোটখাটো বিরোধ সংক্রান্ত মামলাগুলি এসপি বা এডিশনাল এসপির পক্ষে দেখা সম্ভব হয়না। অনেক সময় ব্যস্ততা জনিত কারনে বা অবহেলা করে এএসপিরা এসব মামলা দেখেন না। মাঠ পর্যায়ে কাজের অভিজ্ঞতায় দেখেছি এসব মামলায়ই জনহয়রানি বেশী হয় এবং সাধারন ও নিরপরাধ মানুষ ক্ষতিগ্রস্থ হয়, দালাল বাটপারদের কবলে পড়ে অসৎ পুলিশ সদস্যদের হয়রানির শিকার বেশী হয়। এরফলে পুলিশের ভাবমূর্তি সংকট হয়, মানুষের পুলিশ ভীতি বাড়ে।

থানা পর্যায়ের পুলিশ অফিসাররাও ধরে নেয় এসব মামলার বিষয় সিনিয়র অফিসাররা সেভাবে গুরুত্ব দিয়ে দেখবেন না। কাজেই তারাও অনেক ক্ষেত্রে পেয়ে বসে। এ কথা অনস্বীকার্য্য যে, সততা ও ন্যায়কে ভিত্তি করে কাজ করা মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তার সংখ্যাও অনেক তেমনি গরীব মানুষের রক্ত চুষে খাওয়া পুলিশ অফিসারও আছে।প্রপার সুপারভিশনের মাধ্যমেই সামগ্রিক সেবার মান বাড়ানো সম্ভব।

ব্রাহ্মনবাড়িয়া জেলাটি জ্ঞানে বিজ্ঞানে, শিল্পে, সংস্কৃতিতে অনেক ঐতিহ্যবাহী। প্রতিটি জনপদেরই হয়তো কিছু খারাপ বৈশিষ্ট্যও থাকে। ব্রাহ্মনবাড়িয়ার বদনাম আছে দাঙ্গা নিয়ে। খুব ছোটখাটো বিষয় নিয়ে মারামারি হয়। যে মারামারি ব্যক্তি পর্যায়ে শুরু হলেও প্রথমে গোষ্ঠী এরপর গ্রাম, ইউনিয়নএমনকি দুই থানা এলাকার মধ্যেও বিস্তৃত হয়ে যায়। ছোট করে একটি গল্প বলি। গ্রামের এক লোক হাটে গিয়েছে পান কিনতে। দোকানদার পানটা প্যাকেট ছাড়া দিছে। ক্রেতা বলেছে একটি পলিথিন দিতে। বিক্রেতা কটাক্ষ করে জিজ্ঞেস করেছে তোমার বাড়ী কোন গ্রামে। সে হয়তো বলছে ভগলপুর। বিক্রেতা বলল যা ভাগ, ভাগলপুরের লোকের আবার প্যাকেট লাগবে! এ নিয়ে ক্রেতা বিক্রেতার কথা কাটাকাটি, হাতাহাতি। সেখানেই শেষ নয়। ক্রেতা ফিরে গিয়ে তার গ্রামের লোককে বলল আমাদের গ্রাম তুলে মান অপমান করেছে অমুক গ্রামের পান বিক্রেতা। গ্রামের একদল লোক লাঠিসোটা নিয়ে পান দোকানদারকে মারধর। খবর পেয়ে পান দোকানদারের গ্রামের লোক ও বল্লম, টেটা নিয়ে ভাগলপুর আক্রমন বাকীটা ইতিহাস…………….। ফলাফল নিহত ২, হাসপাতালে ভর্তি ৩৬, তারমধ্যে ঢাকায় রেফার্ড ৫, ৪টি গ্রামে ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ। অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের নেতৃত্বে দাঙ্গা পুলিশ মোতায়েন।

এসব নানা করনেই মারামারি বা দাঙ্গায় মামলাগুলির অনেকগুলোই নিজে দেখার চেষ্টা করতাম। এতে করে দালাল বাটপার দের কবলে পড়ে সাধারন মানুষের হয়রানিটা কমতো বলে মনে করি। হয়রানি কমানোর সবচেয়ে ভাল পদ্ধতি হচ্ছে দ্রুত মামলা নিষ্পত্তি করা এবং ঘটনাস্থল পরিদর্শনের সময়ই অহেতুক মামলায় জড়িয়ে পড়া নির্দোষ ব্যক্তিদেরকে দায়মুক্তির ধারনা দেয়া।এতে করে রক্ত চোষার সুযোগটি আর থাকে না।

একদিন অফিসে বসে মামলার ডকেট দেখতে গিয়ে এমনি একটি মারামারির মামলায় নজর আটকে গেল। বাদী হিন্দু, আসামী ৫০/৬০ জন সকলে মুসলমান, সাক্ষী হিন্দুই বেশী, মুসলিমও আছে কয়েকজন। কিছুটা উদ্বেগ কিছুটা আগ্রহ নিয়ে ঘটনা পড়লাম। মুসলমান আসামীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয়েছে তারা দলবেধে একটি হিন্দু জেলে পল্লীতে এক দরিদ্র জেলের বাড়ীতে আক্রমন করেছে। ৫০/৬০ জন লোক অন্য পাড়া থেকে গিয়ে একটা জেলে পল্লীতে একজন নির্দিষ্ট জেলের বাড়ীতে হামলা করার বিষয়টিতে খটকা লাগল। ওসিকে জিজ্ঞেস করলাম। বলল মেয়ে সংক্রান্ত ঝামেলা, মেয়ের বাপ ছেলে পক্ষের বিরুদ্ধে মামলা করেছে।

মেয়েটি অনার্সের ছাত্রী, হিন্দু এসব বিবেচনায় ঘটনা অত বড় না হলেও তিনি মামলা রেকর্ড করেছেন যাতে সাম্প্রদায়িক অসন্তোষ না হয় এজন্য বলে আমাকে জানালেন। ঘটনাস্থল নাসিরনগর থানার মেঘনা তীরবর্তী একটি গ্রাম। ওসিকে বললাম আমি যাব। তিনি ডিসকারেজ করলেন কারন তখন সবে বর্ষা শেষ। এলাকাটি হাওডের মধ্যে। সরাসরি যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। গাড়ী বা নৌ পথ কোনভাবেই যাওয়া যাবেনা। জিজ্ঞেস করলাম বাদী মামলা কি থানায় এসে করেছে ? ওসি জানালেন হ্যা। আমি বললাম বাদী যেভাবে এসেছে আমিও সেভাবে যাব।

কবে যাব কিছুই বললামনা। ওসি সাহেব হয়তো ভাবলেন স্যার ভুলে যাবে। ৪/৫ দিন চলে গেছে আমিও আর কিছু বলিনা। এর মধ্যে ব্যক্তিগতভাবেও একটু খোঁজ খবর নিলাম। আমি কোন জটিল বিষয়ে জানতে সরাসরি চৌকিদার দফাদার বা গ্রামের স্কুল, মসজিদের ইমাম বা পুরোহিতকে জিজ্ঞেস করতাম এবং সরাসরি নিজে ফোন ডায়াল করতাম। চৌকিদার, দফাদার, স্কুল শিক্ষক, ইমাম, মুয়াজ্জিন, পুরোহিত এরকম অস্যখ্য মানুষের এলাকা ভিত্তিক কন্ট্রাক্ট লিস্ট রাখতাম। নিজের অভিজ্ঞতায় দেখেছি এসব শ্রেনীর মানুষকে উর্দ্ধতন কেউ সরসরি কছু জানতে চাইলে তারা সাধারণত বিভ্রান্ত করেনা। সঠিক তথ্য দেয় এবং সহযোগিতা করতে পেরে সম্মানিত বোধ করে।কাজের সুবিধার্থে চৌকিদার দফাদার ইমাম বা মুয়াজ্জিনরা যেন এসপির ফোন নাম্বার সেভ করে রাখে সে ব্যবস্হা করা হত।

চৌকিদার কে ফোন করে জানতে চাইলাম ঘটনা কি? চৌকিদার জানালো মেয়েটি হিন্দু, দেখতে সুন্দর। প্রেম করত পাশের গ্রামের এক হিন্দু ছেলের সাথে। ছেলেটি গরীব কিন্তু মেয়ের পরিবারের মত অতটা না। ছেলেটি সম্প্রতি একটি সরকারী চাকরি পেয়েছে। মেয়ের বাবা জেলে এবং অত্যান্ত গরীব। মেয়েটিকে উত্যক্ত করে তার এলাকার কিছু বখাটে যুবক-তারা সবাই মুসলমান।

কোন একদিন ছেলেকে মেয়ের সাথে মেয়ের বাড়ীর পাশে কথা বলতে দেখে তারা মেয়েটিকে চরিত্রহীনতার অপবাদ দিয়েছে। এ নিয়ে মেয়েটির পরিবারকে তার সমাজ একঘরে করে দিয়েছে। ছেলের পরিবারও প্রভাবশালীদের হুমকির মুখে তাকে আর ওমুখো হতে নিষেধ করেছে।

সেও সদ্য চাকরি পেয়েছে তখনো জয়েন করেনি। মামলা মোকদ্দমা বা ঝামেলায় পড়ার ভয়ে সেও মেয়েটির খোঁজ খবর নেয়া বন্ধ করে দিয়েছে। একঘরে হওয়ায় মেয়ের বাবা মেয়েকে মারধর ও গালমন্দ করেছে।

প্রেমিকের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ, সামাজিক ও পারিবারিকভাবে অস্পৃশ্য হওয়ার অপমানে মেয়েটি মেঘনায় ঝাঁপ দিয়ে মরার চেষ্টা করেছে। জেলের মেয়ে, জেলেরাই মেঘনার বুক থেকে পরপারের স্বেচ্ছাযাত্রীকে উদ্ধার করেছে। এরপর ঐ মেয়েকে আবারো কুপ্রস্তাব দিয়েছে গ্রামে বখাটেদের কয়েকজন। মেয়ে প্রতিবাদ করেছে। এবারে তার পাশে দাঁড়িয়েছে তার পরিবার ও জেলে সম্প্রদায়। সামান্য জেলেদের এত অহং প্রতিপত্তিশালীরা মানবে কেন? তারা গিয়ে জেলেপাড়া আক্রমন করেছে মেয়ের ঘরে তার প্রেমিক আছে এই অপবাদ দিয়ে। জেলেরাও খেটে খাওয়া মানুষ।প্রমত্তা মেঘনায় তাদের জীবিকা নির্বাহ করতে হয়। অর্থ বিত্ত না থাকলেও সাহসের অভাব নেই। বৈঠা, লগি নিয়ে তারাও প্রতিবাদ করেছে, ফলাফল এই মামলা।

চৌকিদারের কাছ থেকে এ কাহিনী শুনলাম, আইওকে বললাম ডকেট নিয়ে অফিসে আসতে। এক সন্ধ্যায় ডকেট দেখলাম। আইও কেও জিজ্ঞেস করলাম। আইও মামলা সম্পর্কে আমার পূর্ব ধারনা আছে বুঝতে পেরে হোক বা যেকারনেই হোক সব সত্যি কথা বলল। তদন্তকারী অফিসার আর চৌকিদারের কথা মোটামুটি মিলে গেল।

কাউকে কিছু না বলে হঠাৎ তারপর দিন দুপুর ১২ টার দিকে থানায় হাজির হলাম। থানা ফাঁড়ি আকস্মিক পরিদর্শন আমি মাঝে মাঝেই করতাম। তাতেই প্রকৃত চিত্রটা পাওযা যেত, ভুল ত্রুটি সংশোধন হত। মানুষ সেবাটা পেত। ওসিকে বললাম ঐ মামলার ঘটনাস্থলে যাবো। উনি আমতা আমতা করলেন যোগাযোগ ব্যবস্থার দোহাই দিয়ে। বললাম ভাই আমি গাঁও গ্রামের মানুষ। পায়ে হেঁটে, সাইকেলে চেপে স্কুল কলেজ করেছি, আমার অসুবিধা নেই। থানা থেকে মাত্র ১৮ কিলো মিটার রাস্তা। হেঁটে গেলেও তো বড় জোর দুঘন্টা লাগবে।

দুপুরের পরপরই গাড়ীতে, নৌকায় সিএনজিতে, পায়ে হেঁটে শেষ পর্য্যন্ত ঘটনাস্থলে পৌছলাম সূর্য্য তখন ডুবুডুবু। মেঘনা পাড়ের জেলে পল্লী, হাওড় কেবল শুকিয়ে আসছে। শীতে এইসব হাওড়ের মধ্য দিয়েই সাইকেল, মটরসাইকেল, সিএনজি, ট্রাক্টর এসব চলে। বর্ষায় সব জায়গায় যাওয়া যায় নৌকা দিযে। না শীত না বর্ষার এই মাঝামাঝি সময়েই যত সমস্যা। পানিও শুকায়না আবার নৌকাও চলেনা। ফলে হাটা ছাড়া বিকল্প থাকেনা। তাও সোজা পথে না যেতে হয় ঘুরপথে। অনেকটা নাক বেড় দিয়ে কান ধরতে হয়।

মাগরিবের ঠিক আগে ওখানে গিয়ে পৌছলাম। সোজা গিয়ে উঠলাম গ্রামের মসজিদে। ওসি সাহেবের কাছে থেকে খবর পেয়ে চাতলপাড় ফাঁড়ির আইসি, স্থানীয় চেয়ারম্যান, পার্শবর্তী স্কুলের হেডমাষ্টার সহ স্থানীয় গন্যমান্য ব্যক্তিদের অনেকেই সেখানে উপস্থিত হয়েছেন। চেয়ারম্যান সাহেব প্রবীন লোক। তিনি জানালেন এ গ্রামে তার জানামতে এসপি বা এ পর্যায়ের কোন কর্মর্তার আগমন এটিই প্রথম। এমন কি ভোটের সময় ছাড়া অন্য কোন সময়ে কবে তারা ইউএনও বা ওসিকে ঐ গ্রামে দেখেছেন তাও মনে করতে পারেননা।

একসাথে মসজিদে মাগরিবের নামাজ পড়লাম। এশার ওয়াক্তে গ্রামবাসীর সাথে কথা বলব বলে চেয়ারম্যান,হেডমাস্টার সাহেব এবং পুলিশ সহকর্মী ছাড়া অন্যদেরকে বিদায় দিয়ে মেয়ের বাড়ীতে গেলাম। মেয়ের বাবা মাকে দেখলাম। একেবারেই মেঘনার পাড়ে ৩ শতক জায়গার উপর দুটি কুড়ে ঘর। একটিতে নিজেরা থাকে, আরেকটিতে গরু-ছাগল। ঘরে মেয়ে থাকে ছোট বোনটিকে নিয়ে। বারান্দায় বাবা মা। বাড়ীতে বসার কোন ব্যবস্থা নেই। আশেপাশের বাড়ীগুলোতেও তাই। যাহোক ফাড়ির আইসি, মেম্বার আর চৌকিদারের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ৫/৭ বাড়ী থেকে ৮/১০ টি চেয়ার, টুল, কেরোসিনের কুপি যা দিয়ে তারা হাটে মাছ বিক্রি করে যোগাড় হল। আমরা বসলাম। প্রাথমিক বিবরন পেলাম চৌকিদারের কথা মতই।

ওসি এবং আইওকে নিয়ে মেয়ের মা বাবার উপস্থিতিতে মেয়ের সাথে কথা বললাম। মেয়েও জানাল ছেলেটি তার তিন বছরের সিনিয়র। একই স্কুলের ছাত্র হওয়ায় পূর্ব পরিচিত। ছেলে তার ক্লাসে ফাস্ট, সেকেন্ড হত। মেয়েটি বরাবরই তার ক্লাসে ফাস্ট হত। ভাল ছাত্র হিসাবে স্কুলের এই সিনিয়র ভাই এর প্রতি তার আকর্ষন সেই কিশোরী বেলা থেকেই। ছেলেটির অবস্থাও তাই। স্ব-জাত, ভাল ছাত্রী এবং দেখতে সুশ্রী হওয়ায় ছেলেটিও সেই কিশোর বয়স থেকেই মেয়েটিকে পছন্দ করতো। পড়াশুনায় সাহায্য করত। ছেলেটির বই, নোট পড়েই মেয়েটিও ভাল রেজাল্ট করে এসএসসি পাশ করেছে। পাশের কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েটও পাশ করেছে। ইচ্ছে ছিল ডাক্তার হবে। এজন্য খরচ ও কষ্টবেশী জেনেও সায়েন্স পড়েছে। কোচিং করতে না পেরে মেডিকেলে চান্স পায়নি। সরকারী কলেজে গিয়ে অনার্সে ভর্তি হয়েছে। ছেলেটিও একই কলেজ থেকে অনার্স পাশ করে একটি সরকারী চাকরিও পেয়ে গেছে এই দুর্মূল্যের বাজারে। এই তার কাহিনী।

ছেলে এবং তার বাবাকে ডাকলাম। খবর পেয়ে আগে থেকেই অপেক্ষা করছিল আশেপাশে। শান্ত সুদর্শন ছেলেটি। সারা মুখে তীব্র বেদনার ছাপ, ছেলে মেয়ে দুজনার চোখে মুখেই। শুধুমাত্র ছেলে আর মেয়েটিকে উঠানের একপাশে নিয়ে আলাদা করে কথা বললাম। আমার উপস্থিতিতেই অনেক ঝড়ঝাপটার পর তাদের চোখাচোখি হল। মেয়েটির চোখে জল। ছেলেটির অবস্থাও জলদগম্ভীর। মিনিট খানেক বিরতি দিয়ে ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করলাম “ভালবাসো?” এসপি সাহেবের কাছ থেকে এতটা সরাসরি প্রশ্ন মনে হয় ছেলেটি আশা করেনি। বড় বড় চোখে আমার দিকে তাকাল। এই অগ্রহায়নেও তার চোখে শ্রাবন ধারা। সময় দিলাম। ক্লাশ সেভেনে কুদ্দুস স্যার কারক বিভক্তির উদাহরণ পড়াতে গিয়ে বলেছিলেন ‘‘কান্নায় শোক মন্দী ভূত হয়’’ পরিনত বয়সে এসে বুঝলাম ঘটনা সত্য।

কান্নার প্রাথমিক বেগ সামলে ছেলেকে জিজ্ঞেস করলাম এসব কেন করলে? ছেলেটি এবার হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। তার বাবা ও তখন তার পাাশে। লাজলজ্জার মাথা খেয়ে মেয়েটি তার বাবার সামনেই ছেলেটির হাত শক্ত করে ধরে ফেলল। ছেলে আর বাবার কান্না জড়ানো কন্ঠে জানতে পারলাম ছেলেটিকে বখাটেরা হুমকি দিয়েছে,এ গ্রামে পা দিলে ঠ্যাং ভেঙে বস্তায় ভরে সোজা গাঙে ফেলে দিবে। এটাও বড় কথা না । বড় কথা হচ্ছে তাকে চাকরিতে জয়েন করতে দিবেনা। মামলা টামলা দিয়ে তাকে ফেরারি বানিয়ে ইন্ডিয়া পাঠিয়ে দিবে। গ্রামের এত সুন্দর দরিদ্র পাখিটিকে তারা খাঁচা ছাড়া করতে চায়না হয়তো।

ধর্ষন নিয়ে সারা ভারত যখন তোলপাড় তখন এক গবেষনায় উঠে এসেছে ধর্ষনের বা নির্যাতনের ভিকটিমদের একটি বড় অংশই প্রগতি পথের যাত্রী, অর্থাৎ নিজ প্রচেষ্টায় তারা তাদের অবস্থান পরিবর্তনে প্রত্যয়ী। আমার মনে হয় আমাদের দেশের ক্ষেত্রেও কম বেশী একথা প্রযোজ্য। ছেলেটি সরকারী চাকরী পেয়েছে। মেধাবী মেয়েটিও সরকারী কলেজের অনার্সের ছাত্রী। পড়াশোনা শেষ করতে পারলে ওরও হয়তো একটা চাকরি হয়ে যাবে। পাড়ার যে বখাটেদেরকে ওরা সারা জীবন সমঝে চলেছে তাদেরকেই হয়তো চাকরি পেয়ে বুড়ো আঙুল দেখাবে। এ আশংকা থেকেই মূলতঃ নির্যাতন শুরু হয়। নতুবা মুসলমান ছেলের সাথে তো আর হিন্দু মেয়ের বিয়ে হবেনা, তাকে বিরক্ত করার কি আর কারন থাকতে হবে। নারী লোভ যদি হয় তাহলে তাতো আর এ সমাজে দুষ্প্রাপ্য নয়।

যাহোক আরো সরাসরি ছেলেটিকে বললাম মেয়েটিকে তুমি বিয়ে করবে? ছেলে সাথে সাথে বলল স্যার করব। আমি বললাম এখন দিলে করবা- বলল লগ্ন থাকলে করব। মেয়েকে জিজ্ঞেস করলাম- মেয়ে বাবার দিকে তাকাল। মেয়ের বাবা, ছেলের বাবাকে জিজ্ঞেস করলাম। তারা রাজী কিনা?

সময় দিলাম। চেয়ারম্যান সাহেবকে বসিয়ে রেখে ছেলে মেয়ের পরিবারের মতামত ভালভাবে নেয়ার জন্য আমি ওসি সাহেবকে নিয়ে মসজিদে গেলাম এশার নামাজের জন্য। নামাজ পড়লাম। নামাজ শেষে ইমাম ও মুসল্লিদের সাথে কথা বললাম। তারাও একই ধারনা দিলেন। বখাটেদের অভিভভাবকরাও মাফটাফ চাইলো। নামাজ শেষে আবার মেয়ের বাড়ীতে গেলাম হাটতে হাটতে। চেয়ারম্যান সাহেব করিতকর্মা লোক, পুরোহিতও যোগাড় করে ফেলেছেন। পুঁথি দেখে পুরোহিত বললেন এ সপ্তাহেই লগ্ন আছে। বিয়ের সব আয়োজন ঠিক হল। ছেলেও মেয়ে পক্ষ বার বার করে অনুরোধ করল আমি যেন বিয়েতে উপস্থিত হই। হবু বর কনেকে আশীর্বাদ করে পকেটে যা ছিল আশীর্বাদ হিসাবে মেয়ের বাবার হাতে দিয়ে বিদায় নিলাম।

হাওড়ে তখন মেঘ আর চাঁদের আলোর অদ্ভুত লুকোচুরি। ক্লান্তদেহে ঘটনাবহুল দিন শেষে ফিরছি। কারো মুখে কোন কথা নেই। মনের মধ্যে rewind হচ্ছে বিগত কয়েক ঘন্টার সিনেমাটোগ্রাফি।

ওসি সাহেব গম্ভীর মানুষ। কথা বলেন খুবই কম। উনিই নিস্তব্ধতা ভাঙলেন, বললেন স্যার খুব শান্তি লাগছে। আর সকলেই একই সাথে সমস্বরে বলে উঠলেন ঠিক একই কথা। আমি উনার মতই গম্ভীরভাবে বলে উঠলাম “ধুর ভাই, ক্ষুধায় পেট জ¦লছে, হাঁটতে হবে আরো ঘন্টাখানেক, আর আপনি বলেন শান্তি লাগছে!!

মুখে যাই বলিনা কেন আমারও ভিতরটা তখন ফুরফুরা। আমি বাকের ভাই নই,পুলিশ ওয়ালা,গলায় সুর নেই,সাথে জুনিয়র কলিগরা।
সবভুলে গান ধরলাম “হাওয়ামে উড়তা যায়ে, মেরে লাল দোপাট্রা………।

পুলিশের চাকরি পাওয়ার পর বাবা বলেছিলেন মানুষের পাশে থাকতে। বাবা আজ শুয়ে আছেন বাশবাগানের গাঢ় অন্ধকারে। আমি হাঁটছি হাওড়ের মৃদু আলো আঁধারিতে, দূরে কোথাও ডেকে উঠছে ডাহুক বা পেঁচা, হাতে জ্বলন্ত সিগারেট, খালি পেটেও বিস্বাদ লাগছেনা।

একটু পরপরই আমার বডিগার্ড পানির বোতল এগিয়ে দিচ্ছে। দীর্ঘদিন আমার সাথে থাকে। আর কেউ না বুঝুক ও ঠিকই সেই আধো আলো আধাঁরিতে দেখতে পেয়েছে আমার চোখের কোনের জলের ধারা। পানি খাওয়ার ভঙ্গিতে চোখে মুখে পানি দিলাম। হাওড়ের ঠান্ডা বাতাশে প্রগাঢ় শান্তি। বাবাকে মনে করে নিজেকেই মনে মনে বললাম মানুষের পাশে থাকার আনন্দই আলাদা!!শরীরে ক্লান্তির ছিঁটেফোঁটাও নেই,বরং অদ্ভুত এক শান্তি,কি আনন্দ আকাশে বাতাশে!!!

কাহিনী এখানেই শেষ হতে পারতো। কিন্তু হলনা। একটা এপিসোড বাকী রয়ে গেল। ধর্মীয় নিয়মেই কদিনের মধ্যে ছেলেমেয়ের বিয়ে হয়ে গেল। ছেলে ও মেয়ের বাবা একসাথে এসে আমাকে দাওয়াত দিয়ে গেল। মেয়ের বাবার হাতে কিছু টাকা দিয়ে চুপিচুপি বললাম আমার উপহার। ওসি সাহেব আমার পক্ষ থেকে বিয়েতে যোগ দিলেন। চেয়ারম্যান, বাজারের দোকানদার, জেলে পল্লীর দরিদ্র জেলেরা মিলে বিয়ের আয়োজন করল।

আমাদের বদলীর চাকরি। ওদের বিয়েরও বছর খানেক পর বোধ হয় ব্রাহ্মনবাড়িয়া ছেড়ে ঢাকায় আসলাম। নতুন কর্মস্থল পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স। ২০১৭ সালের সম্ভবত জানুয়ারী ফেব্রুয়ারি মাস। অফিসে কাজ করছি। বেলা ৩টা সাড়ে তিনটা বাজে। স্টাফ বলল স্যার ব্রাহ্মনবাড়িয়া থেকে এক মহিলা, তার স্বামী ও বাচ্চা নিয়ে এসেছে,দেখা করতে চায়।

ব্রাহ্মনবাড়িয়া থেকে প্রায় প্রতিদিনই আমার ঢাকার অফিসে কেউ না কেউ আসে। তাই অবাক হইনি। ওকে বললাম আসতে দাও। ঢুকল ওরা, প্রথমে চিনতে পারিনি। আর চিনবোই বা কি করে। বছর তিনেক আগে,কোন এক সন্ধ্যায় কেরোসিনের আলোয় এক পলক দেখেছিলাম, হ্যাংলা পাতলা ছেলে মেয়ে দুটোকে। আর এরা তো সাক্ষাৎ সাজুগুজু করা জামাই বউ, মেয়েটির কোলে বছর খানেক বয়সের এক দেব শিশু। বেবিটা মনে হল আমার দিকেই তাকিয়ে আছে। পরিচয় জানতে চাইলাম, বসতে বললাম। কিন্তু না বসে স্বামী স্ত্রী দুজনেই টেবিলের এ পাশে চলে আসল। আমার কপালে তখন ভাঁজ। এরা এসে ওদের ভাষায় চরণধুলি নিতে চাইল। বিরক্ত হলাম, প্রয়োজন নাই বললাম। মেয়েটি বলল স্যার আমাদেরকে চিনতে পারেন নি?

আমি ওমুক গ্রামের ওমুক, আপনি আমার জীবন ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। চিনলাম। শরীরে, মুখাবয়বে উপচে পড়া সুখ। সেদিনের সেই অপুষ্ট কিশোরী আজ পরিপূর্ণ নারী, হাতে শাখা, কপালে সিঁদুর, পরনে সুন্দর একটা সবুজ কাতান শাড়ী। পা ছুঁয়ে প্রনাম করল, বোধ হয়, পদধুলিও নিল, জামাই বউ মিলে।

পুলিশ হেডকোয়োর্টার্সের সুসজ্জিত এসি রুমে বসেও মনে হল পেলাম হাওড়ের ঠান্ডা বাতাসের মিষ্টি গন্ধ। পরম কৃতজ্ঞতায় ¯স্রষ্টাকে স্মরন করলাম। ইয়া পরোয়ার দিগার এত সম্মান আপনি রেখেছেন এই পাপীতাপী বান্দার কপালে? বাচ্চাটিকে কোলে নিলাম। টেবিলে কোরিয়া পুলিশের সুন্দর একটি পেপার ওয়েট ছিল। বাচ্চাটি বার বার ওদিকে তাকাচ্ছিল। বোধ হয় পছন্দ হয়েছে। হাতে দিলাম। খুব খুশী হল মনে হল।

হঠাৎ আব্বার কথা মনে হল। মানুষের পাশে থাকা খুব কঠিনও নয়। ওপারে ভাল থাকুন আব্বা। নিজের ছেলে মেয়ে দুটোর কথাও মনে হল। চাকরীর ব্যস্ততায় ঠিক সেভাবে সন্তানদের প্রতি নিজের সকল দায়ীত্ব পালন করতে পারিনি। হঠাৎ পরম স্বস্তি পেলাম বলে মনে হল।হয়তোবা এই শিশুটি বা তার বাবা মায়ের জীবনে আমার যৎসামান্য ভূমিকার পূন্যে আমার বাচ্চা দুটিকেও পরোয়ারদিগার হেফাজত করবেন।

এই সব টুকরো স্মৃতি আছে বলেই জীবন এত সুন্দর। যখন জীবনের পরতে পরতে বিপদ, ভয় বা অন্ধকার নেমে আসে, চোখ বুজে মা-বাবা, পরিবার পরিজনদের পাশাপাশি এসব টুকরো স্মৃতিও স্মরণ করি। অদ্ভুত এক শক্তি আসে ভিতর থেকেই। চলতে থাকি নিজের পথেই। আমার এই পথ চলাতেই আনন্দ,ও আমার এই পথ চলাতেই আনন্দ……….

ঢাকা ০৬ মে ২০২০

———————————

লেখক : অতিরিক্ত ডিআইজি , বাংলাদেশ পুলিশ ।প্রাক্তন পুলিশ সুপার ব্রাহ্মণবাড়িয়া।

 

আপনার মন্তব্য লিখুন

আর্কাইভ

September 2023
M T W T F S S
« Aug    
 123
45678910
11121314151617
18192021222324
252627282930  
আরও পড়ুন
অনুবাদ করুন »