মূল্যায়নে অনীহা
বার্তা সম্পাদক প্রকাশিত: ৫:৪৬ অপরাহ্ণ , ২৩ এপ্রিল ২০২০, বৃহস্পতিবার , পোষ্ট করা হয়েছে 5 years আগে এইচ.এম. সিরাজ : মানুষ। সৃষ্টিকর্তার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি। স্রষ্টা ইচ্ছে করেই একমাত্র মানুষকে দিয়েছেন বিবেকবোধ, জ্ঞানবোধ তথা মনুষ্যত্ব। আর এ বিশেষত্বের জন্যই মানুষ সৃষ্টিকূলের শ্রেষ্ঠতম জীব। সময়ের বিবর্তনে মানুষ তার জ্ঞান-বিবেককে খাটিয়ে এযাবৎ সাধন করেছে অনেক অসাধ্যকেও। এই জগত সংসারে ঘটিয়েছেন বহু পরিবর্তন। তবে এটিও ঠিক যে, জগতে আজ অবধি সাধিত হওয়া পরিবর্তনগুলোকে খাপ খাওয়াতে তথা মানিয়ে নিতে অনেক মানুষকেও আবার চুকাতে হয়েছে চড়া দাম। ধর্ম-দর্শন-বিজ্ঞান যাই হোক না কেন,নতুন একটা কিছুকে মানিয়ে নিতে কিংবা মূল্যায়ন করার বেলায় মানুষের মাঝে কেমন যেনো এক ধরণের অনীহা কাজ করে। খুব সহজেই আমরা ভালো কিছুরও মূল্যায়ন করিনা, করতে চাইও না। অনেকটা ‘জীবদ্দশায় গুণীর কদর না করা’র মতোই। তবে এসব হয়তোবা বিবর্তনের একটা অংশও বটে।
গ্রামীণ সমাজে একটা প্রবাদ বহুল প্রচলিত যে, ‘গাধা পানি খায় ঠিকই, তবে ঘোলা করার পর’। প্রবাদটি যে আমাদের বেলায়ও অনেকটা সাজুয্য, সেটা আমরা হয়তোবা স্বীকার করতে হই দ্বিধান্বিত। বর্তমান সময়ে COVID’19 তথা করোনা ভাইরাস গোটা বিশ্বকেই দোর্দণ্ড প্রতাপে ধাবিয়ে বেড়াচ্ছে। আধুনিক বিশ্বের সকল প্রকারের মারণাস্ত্রও আজ এর কাছে নেহায়েতই তুচ্ছাতিতুচ্ছ। প্রাণঘাতী এই করোনা ভাইরাসের কবল থেকে রক্ষায় গোটা মানবকূল একরকম দিশেহারা। যেকোনো কাজ করার আগে-পরে প্রক্ষালন কিংবা হাত ধুয়া অত্যাবশ্যক। এই অতীব ভালো অভ্যেসটিকে গড়ার জন্য পারিবারিক জীবন থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। যদিও প্রত্যেক বছর ১৫ অক্টোবর ‘হাত ধুয়া দিবস’ হিসেবে বেশ ঘটা করে পালিত হয়ে আসছে বহুদিন ধরেই।অথচ আজকে থেকে ১৭৩ বছর আগে ‘ইগনাজ ফিলিপ স্যামেলওয়াইজ’ নামীয় হাঙ্গেরিয়ান এক চিকিৎসক বলেছিনে হাত ধুতে।আর এটিই হয়েছিলো তখনকার দিনে তাঁর কড়া অপরাধ। কেবল হাত ধুতে শিখিয়েছিলেন বলেই ‘পাগল’ আখ্যা দিয়ে মানসিক হাসপাতালে পাঠানো হয়েছিলো স্যামেলওয়াইজকে। এমনকি এই অপরাধেই পিটিয়ে মারা হয়েছিল ওই চিকিৎসককে।
সেই অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি সময়কাল। ভিয়েনা জেনারেল হাসপাতালে প্রসূতি মৃত্যুর হার ছিলো খুবই বেশি। সাধারণের চাইতেও তিনগুণ বেশি প্রসূতি মারা যেতেন।’চাইল্ড বেড ফিভার’ নামে এক ধরণের সমস্যায় ভরা ছিলো তখন। স্যামেলওয়াইজ লক্ষ্য করলেন এর কারণ অপরিচ্ছন্নতা। প্রসূতি বিভাগের চিকিৎসকদের তিনি নির্দেশ দিলেন, গর্ভবতী মহিলাদের পরীক্ষা করার আগে হাত ভালো করে ‘ক্লোরিনেটেড লাইম’ দিয়ে ধুয়ে নিতে হবে। যে সব যন্ত্রপাতি দিয়ে পরীক্ষা করা হচ্ছে, সেগুলোও ধুয়ে নিতে হবে। তখন চিকিৎসকেরা ভেতরে ভেতরে ক্ষুব্ধ হলেও মানতে বাধ্য হয়েছিলেন। পরে দেখা গেল, শুধু এটুকুতেই মৃত্যুর হার প্রায় ৯৯ শতাংশই কমে গিয়েছে। পুরো বছরে একজনও হাসপাতালে আর মৃত্যু বরণ করলেন না। স্যামেলওয়াইজ খুশি হয়ে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় পরিচ্ছন্নতার কথা বলতে ও লিখতে শুরু করলেন। জীবাণু সম্বন্ধে সঠিক ধারণা না থাকায় তিনি সে কারণটি বলতে পারেন নি। তবে এটুকু সত্য যে, তিনি নানারকম পরিসংখ্যান দিয়েই বোঝানোর চেষ্টা করছিলেন। এরপরও ডাক্তার এবং বিজ্ঞানীরা বেঁকে বসলেন। তারা এমনটিও ভাবতে থাকলেন যে, তবে কি রোগী মারা যাওয়ার জন্য ডাক্তারদেরই দোষারোপ করছেন স্যামেলওয়াইজ? অনেকটা এজন্যই হয়তোবা বেঁকে বসলেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও।
এবার হাঙ্গেরিতে নিজের ঘরে ফিরে এলেন স্যামেলওয়াইজ। অনেককিছু ভেবেই কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষাও করলেন। এরপর ১৮৬১ খ্রিষ্টাব্দে প্রচলিত এক বিজ্ঞান পত্রিকায় গবেষণামূলক প্রবন্ধের মাধ্যমে তিনি জানালেন, টয়লেট ব্যবহার করার পর, ছোটখাটো কোনো অপারেশন বা রোগীকে পরীক্ষা করার পর চিকিৎসকদের ভালো করে হাত ধুয়ে নেওয়া উচিত। কারণ তিনি বারংবারই দেখেছেন, মর্গ থেকে এসে ডাক্তাররা যখন রোগী দেখেন তখন মৃতদেহ থেকে ভয়ঙ্কর কিছু উপাদান রোগীর মধ্যে অনায়াসেই চলে আসে। আর তাতেই অনেকে মারা যান। এতেও কোনরকম লাভ হলো না। কারণ তখন ডাক্তার কিংবা বিজ্ঞানী সবার বিশ্বাস ছিল রোগ-শোক-মৃত্যুর অন্যতম কারণ হচ্ছে ‘দুষ্ট আত্মা’। মানুষের কিছুতেই সাধ্য নেই তাকে (দুষ্ট আত্মা) অতিক্রম করে। একটা পর্যায়ে এসে অন্যান্যদের সঙ্গে সঙ্গে স্যামেলওয়াইজের স্ত্রীও ভাবতে শুরুর করলেন যে, তিনি (স্যামেলওয়াইজ) পাগলের মতো কথাবার্তা বলছেন।
কিছুতেই হাল ছাড়ার পাত্র ছিলেন না স্যামেলওয়াইজ, এমনকি ছাড়লেনও না। এবার তিনি স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞদের চিঠি পাঠিয়ে অনুরোধ করলেন, যাতে হাত ও যন্ত্রপাতি ধুয়ে তবেই রোগীকে পরীক্ষা করেন কিংবা অপারেশন করেন। কেননা, এটি মানুষের প্রাণ বাঁচানোর বড় রাস্তা। আর সবকিছু জেনেও যদি তারা পরিচ্ছন্নতার কাজটুকুই না করেন, তাহলে ধরেই নিতে হবে যে, তারা নিজের অজান্তে মানুষ খুন করার মতো অপরাধ করছেন। এবার পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ আকার ধারণ করলো। সবাই সম্মিলিতভাবেই তাকে পাগল বলতে থাকলেন। ১৮৬৫ খ্রিষ্টাব্দে ‘নার্ভাস ব্রেকডাউন’ হওয়ার পর তাকে পাঠানো হলো মানসিক হাসপাতালে। কেউ কেউ বললেন তার ‘নিউরো সিফিলিস’ হয়েছে, আবার কেউবা এমনটিও বলতে শুরু করলেন, তাকে ‘আত্মা’ ভর করেছে। এসবেরই প্রেক্ষিতে হাসপাতালে চিকিৎসার পরিবর্তে শুরু হলো তাকে মারধর। ১৪ দিনের মাথায় মারের চোটে তিনি হয়ে গেলেন ক্ষতবিক্ষত। কোনোরকম চিকিৎসার সুযোগ পেলেন না, সেভাবেই পড়ে রইলেন। পঁচন ধরল তাঁর ডান হাতে, সেখান থেকে বিষ ছড়িয়ে পড়ল সারা শরীরে।
১৮৬৫ খ্রিষ্টাব্দের ১৩ আগস্ট, বিনা চিকিৎসায় মাত্র ৪৭ বছর বয়সে ‘সেপ্টিসেমিয়া’ হয়ে অবশেষর মারা গেলেন ইগনাস ফিলিপ স্যামেলওয়াইজ। শুধু কি তাই? মারা যাবার পর তাঁর শেষকৃত্যে উপস্থিত হন নি একজন চিকিৎসকও। তাঁকে নিয়ে এক কলমও লেখা হয়নি হাঙ্গেরিয়ান মেডিক্যাল সোসাইটিতে। কিন্তু কালের পরিক্রমায় হারিয়ে যান নি তিনি। দেরিতে হলেও তাঁর মূল্যায়ন হয়েছে লুই পাস্তুরের হাত ধরে। স্বীকৃতি পেয়েছে তাঁর গবেষণা। জীবাণু তত্ত্ব, অর্থাৎ জীবাণু থেকে রোগ হতে পারে, সেটি মেনে নিতে বাধ্য হলেন বিজ্ঞানীরা। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা হয়ে রইলো ইগনাস ফিলিপ স্যামেলওয়াইজের নাম। হাঙ্গেরির রাজধানী বুদাপেস্ট আজ অবধি তাঁর উজ্জ্বল স্বাক্ষর বহন করছে।
আমাদের গ্রাম সমাজে ‘থাকতে কাচি (কাস্তে), হারাইলে দাও (দা)’ বলে একটি প্রবাদ বহুলভাবে প্রচলিত। অর্থাৎ,আমরা সময়মতো কোনোকিছুরই সঠিক মূল্যায়ন করিনা বা মূল্য দেইনা। যখনই কোনোকিছু আমাদের হাতছাড়া হয়, তখনই এর কদর আমরা মর্মে মর্মে পলে পলে উপলব্দি করি। ঐ যে, লেখার শুরুর দিকে ‘গাধার পানি খাওয়ার’ প্রবাদটির কথা বলেছিলাম? অনেকটা সেরকমই। সমাজ-সংসারে এমন নজিরের অভাব নেই। ধর্মীয় বিজ্ঞান দর্শন এমন কোনোই ক্ষেত্র নেই, যেখানে যুগে যুগে কালে কালে জনমানুষের হিত কামনাকারী মহামনীষীদের হেনস্তার শিকার হতে হয়নি। তথাপিও ইতিহাস থেকে আমরা কিছুতেই শিক্ষা নিতে অনিচ্ছুক থেকেই যাচ্ছি। আমাদের মধ্যে কেমন যেনো এক ধরণের হীনমন্যতা কিংবা অনীহাবোধ খুব জোড়ালোভাবেই কাজ করে। তারপরও জোর দিয়ে বলতে চাই- জাগ্রত হোক আমাদের মাঝে সচেতনতাবোধ, মহান আল্লাহ্ আমাদেরকে হেদায়েত করুন, করোনা ভাইরাস নামীয় বর্তমান মহামারীর রাহুগ্রাস থেকে সমগ্র মানবকূলকে রক্ষা করুক, আমিন। তথ্যসূত্র : আনন্দবাজার
লেখকঃ এইচ.এম.সিরাজ : সাংবাদিক-শিক্ষানবিশ অ্যাডভোকেট। নির্বাহী সম্পাদক : দৈনিক প্রজাবন্ধু, ব্রাহ্মণবাড়িয়া।
আপনার মন্তব্য লিখুন