নতুন মাত্রা পত্রিকার অনলাইন ভার্সন (পরীক্ষামূলক সম্প্রচার)

 ঢাকা      শনিবার ২০শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ৭ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

রেনু থেকে বঙ্গমাতা : এক সাহসী যোদ্ধা নারী—ফজিলাতুন নেসা বাপ্পি

বার্তা সম্পাদক

প্রকাশিত: ৮:৫৩ অপরাহ্ণ , ৮ আগস্ট ২০১৯, বৃহস্পতিবার , পোষ্ট করা হয়েছে 5 years আগে

বাংলাদেশের মানচিত্রে সেই এক অতি সাধারণ গ্রাম। নাম টুঙ্গিপাড়া। ঐ গ্রামে ১৮৫৪ সালে নির্মিত পাকা দালানের এক অংশে বাস করতেন শেখ আবুল কাশেম। ১৯৩০ সাল, ৮ আগষ্ট, শ্রাবণ দুপুরে ঐ বাড়িতে জন্ম নিল একটি কন্যা শিশু। দাদা শেখ আবুল কাশেম নাতনীর নাম রাখেন ফজিলাতুননেছা। ফুলের মতো গায়ের রং বলে মা হোসনে আরা বেগম ডাকতেন রেণুু। তিনবছর বয়সে রেণুর বাবা শেখ জহুরুল হক মারা যান। তখন দাদা শেখ আবুল কাশেম রেণুর চাচাতো ভাই শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে তাঁর বিয়ে দেন। বাবার জমিজমা রেণুু ও বড়বোন জিনাতুননেছাকে লিখে দেন দাদা। পাঁচ বছর বয়সে মাকেও হারান তারা। তখন শ্বাশুড়ী সায়েরা খাতুন পরম মমতায় শিশু রেণুুকে নিজের ঘরে নিয়ে আসেন। গোপালগঞ্জের মিশনারী স্কুল থেকে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত পাঠ গ্রহণ করেন রেণু। তারপর গৃহ শিক্ষকের কাছে পাঠ নেন। সাহিত্যে গভীর অনুরাগ ছিল। বিভুতিভূষণ, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর রচনার প্রতি ছিল প্রবল আগ্রহ। নিউমার্কেটে বইয়ের দোকানে যেতেন, পছন্দের বই কিনে পড়তেন। প্রখর স্মৃতি শক্তির অধিকারী ছিলেন বলে বঙ্গবন্ধু তাঁকে ‘জীবন্ত ডায়েরী’ বলতেন। গান গাইতে ভালোবাসতেন। জ্যৈষ্ঠ পুত্র শেখ কামাল সেতার বাজাতেন, গান গাইতেন, ক্রীড়া সংগঠক ছিলেন। মেজ পুত্র শেখ জামাল ছবি আঁকতেন, পুত্র-কন্যাদের ছায়ানটে ভর্তি করিয়েছিলেন।

বঙ্গবন্ধুর বিশ বছর বয়সে তাদের আনুষ্ঠানিক বিয়ে হয়। বঙ্গবন্ধু কোলকাতায় লেখাপড়া ও রাজনীতি করতেন, দফায় দফায় কারাবরণ করেছেন। এই নিয়ে কোন অভিযোগ ছিলনা তাঁর। বঙ্গবন্ধু ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে লিখেছেন, “রেনু খুব কষ্ট করত কিন্তু কিছুই বলতোনা। নিজে কষ্ট করে আমার জন্য টাকা পয়সা জোগাড় করে রাখত। যাতে আমার কষ্ট না হয়।”

’৪৪ সালের ডিসেম্বরে তাঁদের প্রথম সন্তান জন্মের সময় মারা যায়। দুই কন্যা ও তিন পুত্র সন্তানের মধ্যে ’৪৭ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর জন্মগ্রহণ করেন কন্যা শেখ হাসিনা, যিনি বাংলাদেশের তিনবারের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী।’৪৯ সালে পুত্র শেখ কামাল, ’৫৩ সালে শেখ জামাল, ’৫৭ সালে কন্যা শেখ রেহানা,’৬৪ সালে পুত্র রাসেল জন্মগ্রহন করে।

অনন্য মানবিক গুণাবলী ছিল তাঁর। ঘরে বসে নিজেই স্কুল খুলে মেয়েদের লেখাপড়া, সেলাই শেখাতেন। গরীব ছেলেমেয়ে, এতিম, কন্যাদায়গ্রস্থ পিতামাতাকে অর্থ সাহায্য করতেন। দলের নেতাকর্মীদের চিকিৎসার খরচ দিতেন। সংগঠন ও আন্দোলন সংগ্রামে বঙ্গবন্ধুর প্রয়োজন মেটাতে নিজের সম্পদ বিলিয়ে দেন। মমতা ও আপ্যায়নে অতুলনীয় ছিলেন। তাঁর কাছ থেকে কেউ কোনদিন রিক্ত হয়ে ফেরেনি।

বাংলার নিপীড়িত মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে বঙ্গবন্ধু অহর্নিশ গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ঘুরেছেন, জীবনের সোনালী চৌদ্দ বছর কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে ছিলেন।বঙ্গমাতা সন্তান প্রতিপালন ও লেখাপড়া করানোর পাশাপাশি বঙ্গবন্ধু গ্রেফতার হলে আইনজীবী নিয়োগ, মামলা চালানোর খরচ, কোর্টে যাওয়া, নিজে রান্না করে কারাগারে নিয়ে যাওয়া, সাক্ষাতের সময় সব কিছু পুংখানুপুংখ জানিয়ে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনা আওয়ামীলীগ ও ছাত্রলীগের কাছে পৌছে দিয়ে তা কার্যকর করতেন। বাড়ীতে দলের সভা পরিচালনা, দলের খরচ যোগানো, রান্না করে নেতাকর্মীদের খাওয়ানো সবকিছু সুনিপুণভাবে সম্পাদন করতেন। মামলার খরচ ও সংগঠনের খরচ যোগাতে নিজের গহনা, ঘরের ফ্রিজ বিক্রয় করেছেন তিনি।

’৫৪ সালের ১০ মার্চ, প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট বিজয়ী হয়, বঙ্গবন্ধু সদস্য নির্বাচিত হন। টুঙ্গিপাড়া থেকে বঙ্গমাতা ছেলেমেয়েদের নিয়ে ঢাকায় আসলেন, রজনী বোস লেনে একটি ভাড়া বাড়ীতে বসবাস শুরু করলেন। ১৫ মে, বঙ্গবন্ধু কৃষি উন্নয়ন, বন ও সমবায় মন্ত্রী নিযুক্ত হন। ৩০মে, পাকিস্তান সরকার পূর্ববাংলা মন্ত্রীসভা বাতিল করে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে।

’৫৬ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর, বঙ্গবন্ধু শিল্প, বাণিজ্য, শ্রম ও ভিলেজ এইড মন্ত্রী নিযুক্ত হন। মন্ত্রীর চেয়ে দলের দায়িত্বকে প্রাধান্য দিয়ে স্বেচ্ছায় মন্ত্রীত্ব ছেড়ে দল গোছাতে মনোযোগ দিলেন বঙ্গবন্ধু। এই নিয়ে কোন অনুযোগ ছিলনা বঙ্গমাতার। হাসি মুখে স্বামীর সিদ্ধান্তকে সমর্থন করেছেন।

’৫৮সালের ৭ অক্টোবর- আইয়ুব খান সামরিক শাসন জারী করে সংসদ ভেঙ্গে দেয়। ১২ অক্টোবর বঙ্গবন্ধু গ্রেফতার হন। শুরু হলো বঙ্গমাতার কষ্ট নদীর অনিরুদ্ধ উপাখ্যান। স্বামী কারাগারে, কেউ বাড়ী ভাড়া দিতে চাইলোনা। তিন দিনের নোটিশে সন্তানদের নিয়ে বাড়ী ছাড়তে হলেও তিনি অটল থেকেছেন হিমালয়ের মত।এ প্রসঙ্গে কন্যা শেখ হাসিনা বলেন,“বঙ্গবন্ধুর দীর্ঘ রাজনীতিক জীবন, লড়াই, সংগ্রামে অনেক ঘাত-প্রতিঘাত এসেছে, কিন্তু কখনো মাকে ভেঙ্গে পড়তে দেখিনি। যতো কষ্টই হোক আমার বাবাকে কখনোই বলেননি যে তুমি রাজনীতি ছেড়ে দাও বা সংসার কর বা খরচ দাও। আব্বা যে পদক্ষেপ নিতেন সেটাকেই সমর্থন করতেন তিনি।”

নিজের জমানো টাকা ও আবাসন ঋণ নিয়ে ধানমন্ডির বত্রিশ নম্বর বাড়ী নির্মান করেন। এ প্রসঙ্গে বেবী মওদুদ ‘মহীয়সী নারী বেগম ফজিলাতুননেছা’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, “সব কাজ নিজে দাঁড়িয়ে থেকে তদারকি করতেন। খরচ বাঁচানোর জন্য নিজের হাতে পানি দেয়া, ইট ভেজানোসহ বহু শ্রম, যত্ন ও মমতা দিয়ে বত্রিশ নম্বরের বাড়ীটি নির্মান করেন।”

স্বাধীনতার জন্য বঙ্গমাতার মহান ত্যাগ ইতিহাসে চিরভাস্মর হয়ে আছে।আব্দুল গাফফার চৌধুরীর ‘ধীরে বহে মেঘনা’ গ্রন্থ থেকে জেলাখানায় স্বামীকে লেখা বঙ্গমাতার একটি চিঠির অংশ উল্লেখ করছি, “আপনি শুধু আমার স্বামী হওয়ার জন্য জন্ম নেননি, দেশের কাজ করার জন্যও জন্ম নিয়েছেন, দেশের কাজই আপনার সবচাইতে বড় কাজ, আপনি নিশ্চিত মনে সেই কাজে যান, আমার জন্য চিন্তা করবেন না।”

’৬৬ এর ৫ ফেব্রুয়ারি, বঙ্গবন্ধু বাঙ্গালীর মুক্তির সনদ ছয় দফা ঘোষণা করেন।৮ মে, নারায়নগঞ্জে ছয়দফার সমর্থনে জনসভা করে ঘরে ফেরার পর গভীর রাতে গ্রেফতার হন। ঐ সময় ছয়দফা না আটদফা বিভ্রান্তিতে অনেক নেতাও আটদফার পক্ষে কথা বলেন। ছয়দফা থেকে একচুলও নড়া যাবে না- বঙ্গবন্ধুর এই নির্দেশ বাস্তবায়নে বঙ্গমাতা ঐতিহাসিক ভূমিকা রাখেন।ছয়দফার সমর্থনে বোরকা পরে জনসংযোগ করেন।

’৬৮ সালের ৩ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু ও চৌত্রিশ নেতার বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করা হয়। বঙ্গবন্ধু কোথায় আছেন, বেঁচে আছেন কিনা এই খবর অজানা ছিল। সেনাবাহিনীর এক ক্যাপ্টেন বঙ্গমাতাকে জিজ্ঞাসাবাদে কোন তথ্য না পেয়ে হুমকি দেয় প্রয়োজনে বঙ্গমাতাকে গ্রেফতার করা হবে। তিনি ভয় পাওয়ার মানুষ নন। ঐ সময় প্রতিটি বন্দী পরিবারের নিয়মিত খোঁজ-খবর নেন ও সহযোগিতা করেন এবং মামলা পরিচালনার জন্য প্রবাসী বাঙ্গালীদের সহায়তায় লন্ডন থেকে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আইনজীবী স্যার টমাস উইলিয়ামকে ঢাকায় নিয়ে আসেন।

বঙ্গমাতার দূরদর্শিতা বাংলাদেশের স্বাধীনতার পথ খুলে দিয়েছিল। কন্যা শেখ হাসিনার উদ্ধৃতি, “পাকিস্তান সরকার আম্মাকে ভয় দেখায়, বঙ্গবন্ধু প্যারোলে মুক্তি না নিলে তিনি বিধবা হবেন। মা সোজা বলে দিলেন, কোন প্যারোলে মুক্তি হবেনা। নি:শর্ত মুক্তি না দিলে কোন মুক্তি হবেনা। আমি মায়ের সিদ্ধান্তের কথা বঙ্গবন্ধুকে যখন জানালাম তখন অনেক আওয়ামীলীগ নেতাকে ও দেখেছি আমাকে বলতে, তুমি কেমন মেয়ে? বাবার মুক্তি চাওনা? আম্মাকে বলেছে, ভাবী আপনি কিন্তু বিধবা হবেন….।” লেখক সৈয়দ বদরুল আহসান, From Rebel to Founding Father: Sheikh Mujibur Rahman গ্রন্থে উল্লেখ করেনঃ She passed on the message to Mujib— Mujib listened to his wife. He did not give any thought to freedom on parole any more.” ”বঙ্গবন্ধু যদি প্যারোলে যেতেন বাংলাদেশ স্বাধীন হতোনা। বঙ্গমাতার বিচক্ষণতা স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে ধ্রুবতারার মত।

পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষণ ৭১ এর ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু প্রদান করেছিলেন, যে ভাষণ বুকে নিয়ে নিরস্ত্র বাঙ্গালী সশস্ত্র হয়েছিল, রক্ত দিয়ে স্বাধীনতার লাল সূর্য ছিনিয়ে এনেছিল। কেমন ছিলো সেই ভাষণ প্রদানের প্রেক্ষাপট? কি ভূমিকা ছিল সেখানে বঙ্গমাতার? কন্যা শেখ হাসিনার স্মৃতিচারন মূলক এক বক্তব্যে পেয়েছি সন্ধান-“জনসভায় যাওয়ার কিছুক্ষণ পূর্বে আব্বা কাপড় পড়ে তৈরি হবেন, মা আব্বাকে নিয়ে ঘরে এলেন। দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে আব্বাকে বললেন ১৫ মিনিট চুপচাপ শুয়ে থাকার জন্য। আমি আব্বার মাথার কাছে বসে মাথা টিপে দিচ্ছিলাম। মা বেতের মোড়াটা টেনে আব্বার কাছে বসলেন। যে কোন বড় সভায় বা গুরুত্বপূর্ণ কাজে যাওয়ার আগে আমার মা আব্বাকে কিছুক্ষণ একদম নিরিবিলি রাখতেন। মা আব্বাকে বললেন, সমগ্র দেশের মানুষ তোমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। তোমার মনে যে কথা আসে তুমি তাই বলবে। অনেকে অনেক কথা বলতে বলেছে। তোমার কথার উপর সামনের অগণিত মানুষের ভাগ্য জড়িত। ”বঙ্গমাতার প্রেরণা থেকে রাজনীতির কবিগণ সূর্য্যরে মঞ্চ কাঁপিয়ে শুনিয়েছিলেন স্বাধীনতার অমোঘ মন্ত্র, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’

৭১ এর ২৫মার্চ, দিবাগত রাতে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।বত্রিশ নম্বর বাড়ি আক্রমণ করে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায় পাকিস্তানী সেনারা, বঙ্গমাতা ছেলেমেয়ে নিয়ে প্রথমে পাশের বাসায় আশ্রয় নেন। বত্রিশ নম্বর বাড়ী তছনছ করে, টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর মা বাবার সামনে বাড়ী আগুনে পুড়িয়ে দেয়। বড় ছেলে শেখ কামাল ২৫ মার্চ রাতেই মুক্তিযুদ্ধে যান, আটক অবস্থায় শেখ জামাল ও যান।উনিশবার জায়গা বদল করেও রেহাই পেলেন না, একদিন মগবাজারের বাড়ী থেকে ছেলে-মেয়ে সহ বঙ্গমাতাকে গ্রেফতার করে ধানমন্ডির ১৮ নম্বর রোডের একটি বাড়ীতে রাখে পাকিসেনারা, বঙ্গবন্ধু বেঁচে আছেন কিনা জানতেন না। বন্দি অবস্থায় কন্যা শেখ হাসিনার সন্তান জন্ম নেয়ার সময় তাঁকে একবারের জন্যও ঢাকা মেডিক্যালে যেতে দেয়া হয়নি। কনিষ্ঠা কন্যা শেখ রেহানা ‘একজন আদর্শ মায়ের প্রতিকৃতি’ লেখায় এ প্রসঙ্গে বলেছেন,“জুলাই মাসের শেষ দিকে হাসু আপা হাসপাতালে গেল। মা যাওয়ার জন্য তৈরি হয়েও যেতে পারলেন না। সৈন্যরা তাকে যেতে দিলনা। বলল, ‘তুমি কি নার্স না ডাক্তার যে সেখানে যাবে’ মা খুব কষ্ট পেয়ে সারারাত কেঁদেছিলেন।” বন্দি অবস্থায় তিনি অসুস্থ্য শ্বশুর-শ্বাশুড়ীর চিকিৎসার ব্যবস্থা করান তৎকালীন পিজি হাসপাতালে (যা বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়), সেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে সাক্ষাৎ করতেন, খবরাখবর আদান প্রদান করতেন।

তাঁদের যুদ্ধ দিনের বন্দীদশার অবসান ঘটে ১৭ ডিসেম্বর। মুক্তি পেয়ে বঙ্গমাতা বাড়ির ছাদ থেকে পাকিস্তানের পতাকা নামিয়ে টুকরো টুকরো করে আগুন ধরিয়ে দেন। জয় বাংলা শ্লোগান দেন। এসময় হাজার হাজার জনতা ছুটে আসে।

তিনি বাংলাদেশকে গভীর ভাবে ভালবাসতেন। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা নির্মাণে অনন্য ভূমিকা রাখেন। মুক্তিযুদ্ধে নির্যাতিতা নারীদের পুণর্বাসনে সক্রিয় পদক্ষেপ নেন, বীরাঙ্গনাদের বিয়ে দেন নিজ উদ্যোগে। চিরদিন কেবল দিয়েই গেছেন, নিজের জন্য কিছুই চাননি। একটি দেশের জাতির পিতা, প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির স্ত্রী হয়েও সহজ-সরল, সাধারণ জীবন যাপন করতেন। কোন দিন প্রচার চাননি।

তিনি বঙ্গবন্ধুকে শক্তি, সাহস, মনোবল, অনুপ্রেরণা দিয়েছেন বলেই আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি, বঙ্গবন্ধু ‘জাতির পিতা’ হয়েছেন। বঙ্গবন্ধু জীবনে যত ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করেছেন সবটাতেই বঙ্গমাতা তাঁকে ছাঁয়ার মত সাহায্য করেছেন।ডঃ নীলিমা ইব্রাহিম বলেন,“রেণু ছিলেন নেতা মুজিবের Friend, Philosopher and Guide.””

বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা অবিছিন্ন সত্তা ছিলেন। ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব’ গ্রন্থে মযহারুল ইসলাম লিখেছেন, “আমি বঙ্গবন্ধুর অনাবিল সাক্ষাতকার লাভ করেছি। একবার তিনি বলেন, ‘আমার জীবনে দুটো বৃহৎ অবলম্বন আছে– একটি আমার আত্মবিশ্বাস, অপরটি — তিনি একটু থেকে আমাকে বললেন, অপরটি বলুন তো কি?’ হঠাৎ এ-রকম একটি প্রশ্নের জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না। তিনি একটু মৃদু হেসে বললেন,‘অপরটি আমার স্ত্রী, আমার আকৈশোর গৃহিণী।”

তাঁর উৎসাহে বঙ্গবন্ধু কারাগারে আত্মজীবনী লিখেন, ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’, ‘কারাগারের রোজনামচা’ স্বাধীনতা সংগ্রামের অনেক অজানা ইতিহাসের সম্ভার। এই আত্মজীবনী সংরক্ষণে বঙ্গমাতার ভূমিকা ইতিহাস নিশ্চয়ই মনে রাখবে।

৭৫ এর ১৫ আগষ্ট বাঙালী জাতির জীবনে নিকষ কালো অধ্যায়। খুনী মোশতাক, খুনী জিয়া বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে। বঙ্গমাতা সিঁড়িতে বঙ্গবন্ধুর নিথর দেহ পড়ে থাকতে দেখে ঘাতকদের বলেন,“তোমরা আমাকে এখানেই মেরে ফেল।” জীবনের মত মরণেও বঙ্গবন্ধুর সঙ্গী হলেন এই মহাপ্রাণনারী। বিদেশ থাকার কারনে দুই কন্যা প্রাণে বেঁচে যান। অনুভব করি কি কষ্টে তাঁরা বেঁচে আছেন!পিতার সংগ্রামী জীবন ও আদর্শ মায়ের প্রতিকৃতি খুঁজে পাই তাঁদের কর্ম ও জীবনে।

বঙ্গমাতা সংসার, সমাজ, সন্তান প্রতিপালনের পাশাপাশি স্বাধীনতা সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতার পর দেশ পুণর্গঠনে অসামান্য অবদান রেখে ইতিহাসকে যেমন সমৃদ্ধ করেছেন, ইতিহাসও তাঁকে বঙ্গমাতায় অভিষিক্ত করেছে।জাতি তাঁর কাছে কৃতজ্ঞ। এই মহীয়সী নারীর জীবনী চর্চা নতুন প্রজন্মকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করবে।

তিনি বিরাজ করেন বৃষ্টিভেজা জুঁইয়ের শাখায়, পূর্ণিমার আলোয়, বাইগার নদীর ঢেউয়ে পাল তোলা নৌকায়, রবীন্দ্রনাথের বইয়ের পাতায়।

জন্মদিনে বিনম্র শ্রদ্ধা ও অপার ভালবাসা পূণ্যে পূর্ণ হে মুগ্ধ জননী।

জয় বাংলা
জয় বঙ্গবন্ধু

 

লেখকঃ আইনজীবী ।

আপনার মন্তব্য লিখুন

আর্কাইভ

April 2024
M T W T F S S
1234567
891011121314
15161718192021
22232425262728
2930  
আরও পড়ুন
অনুবাদ করুন »