নতুন মাত্রা পত্রিকার অনলাইন ভার্সন (পরীক্ষামূলক সম্প্রচার)

 ঢাকা      সোমবার ১২ই মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ২৯শে বৈশাখ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

শীত, কুয়াশা আর খেজুরের রস

বার্তা সম্পাদক

প্রকাশিত: ১১:০৭ পূর্বাহ্ণ , ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, মঙ্গলবার , পোষ্ট করা হয়েছে 5 months আগে

শীতের ভোর। আকাশে তখনও আলো ফোটেনি, কুয়াশায় মোড়া পথ ধীরে ধীরে জীবন্ত হয়ে উঠছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের পাইকপাড়ার আট তরুণ বন্ধুর দল একটি মাইক্রোবাসে চেপে ছুটছে। গন্তব্য ৪৫ কিলোমিটার দূরের হবিগঞ্জের মাধবপুর উপজেলার বিষ্ণুপুর গ্রাম। শীতের কনকনে হাওয়া উপেক্ষা করে তাদের এই ভ্রমণের উদ্দেশ্য একটাই_তাজা খেজুরের রসের স্বাদ নেওয়া।

তারা ভেবেছিল, এমন হাড়কাঁপানো শীতে এত ভোরে খেজুরের রসের জন্য এত দূর যাওয়া শুধু তাদেরই ‘পাগলামি’। কিন্তু বিষ্ণুপুর পৌঁছেই তাদের সেই ধারণা বদলে যায়। গ্রামের প্রান্তে পৌঁছে তারা দেখে, শুধু তারাই নয়; কিশোরগঞ্জের ভৈরব, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া এবং কুমিল্লার বিভিন্ন প্রান্ত থেকেও অসংখ্য মানুষ খেজুরের রসের মধুর টানে এখানে হাজির হয়েছে। সিলেট, হবিগঞ্জ এবং মাধবপুরের রসপ্রেমীরাও তো ছিলই। কেউ এসেছে মাইক্রোবাসে, কেউ সিএনজি চালিত অটোরিকশায়, কেউ বা মোটরসাইকেলে।

বিষ্ণুপুর গ্রামে পৌঁছে আট বন্ধু গিয়েছিল সেলিম শাহ নামের এক স্থানীয় রস বিক্রেতার বাড়িতে। আগে থেকেই পরিচিত এক ব্যক্তির মাধ্যমে সেলিম শাহ’র মোবাইল নাম্বার সংগ্রহ করে তারা চার লিটার রস অর্ডার করেছিল। সেলিম শাহ’র বাড়িতে গিয়ে তারা অবাক হয়ে দেখে, বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা প্রায় ৫০ জন মানুষ অপেক্ষায় আছে রস সংগ্রহের জন্য।

সেলিম শাহ জানালেন, শীত আসার সঙ্গে সঙ্গে বিষ্ণুপুরের গ্রামীণ জীবনধারা আরও রঙিন হয়ে ওঠে। কার্তিক মাসের শুরুর দিক থেকেই খেজুর গাছ প্রস্তুত করতে শুরু করেন তিনি। এরপর আগ্রহায়ণ মাস এলেই শুরু হয় রস সংগ্রহ। তার নিজের ২২টি খেজুর গাছ রয়েছে, যেগুলো থেকে প্রতিদিন ভোরে ৩৫ থেকে ৪০ লিটার রস সংগ্রহ করা যায়। এই কাজে তাকে সাহায্য করেন পরিবারের আরও দু’জন সদস্য।

ভোর ৩টা থেকে শুরু হয় তাদের দিন। হাঁড়িতে টপটপ করে ঝরে পড়া খেজুরের রস সংগ্রহ করা হয় রাতের কুয়াশাচ্ছন্ন সময়ে, যখন রস সবচেয়ে বেশি সতেজ ও মিষ্টি থাকে। প্রতি লিটার রস ১২০ থেকে ১৫০ টাকায় বিক্রি হয়। প্রতিদিন প্রায় পাঁচ থেকে ছয় হাজার টাকা আয় হয় তাদের। সেলিম শুধু রসই নয়, খেজুরের গুড়ও তৈরি করেন। এই গুড় বিক্রি করেও তার বাড়তি আয় হয়।

সেলিম শাহ শুধু খেজুরের রসের জন্যই পরিচিত নন, তার অতিথি আপ্যায়নের ভিন্নধর্মী ব্যবস্থাও মন কাড়ে। উঠানে কাঠের লাকড়ির আগুন জ্বালিয়ে রেখেছিলেন তিনি, যাতে শীতের কষ্ট লাঘব হয়। আগুনের পাশে বসে রসের স্বাদ নিতে নিতে পর্যটকরা নিজেদের মধ্যে গল্পে মশগুল হন। আগুনের উষ্ণতায় শীতের কনকনে ভাব কেটে গিয়ে সবার মুখে হাসি ফুটে ওঠে। এই আয়োজন যেন সবার জন্য আনন্দের আরেকটি উপহার হয়ে ওঠে।

খেজুরের কাঁচা রস পানের মাধ্যমে “নিপাহ ভাইরাস” ছড়ানোর বিষয় কথা বলতে গিয়ে সেলিম শাহ জানান, “বাদুড় যখন গাছে বাঁধা হাঁড়ি থেকে রস খাওয়ার চেষ্টা করে তখন তাদের লালা বা মলমূত্র রসে মিশে যেতে পারে, যা নিপাহ ভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ায়।” তবে এই ঝুঁকি এড়াতে তিনি বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। সেলিম শাহ তার গাছে বাঁধা হাঁড়িগুলোর ওপর বিশেষ ধরনের জাল ব্যবহার করেন, যাতে বাদুড় কোনোভাবেই রসের সংস্পর্শে আসতে না পারে। তাছাড়া তার এখানে সেদ্ধ খেজুরের রসের ব্যবস্থা আছে। আগে থেকে অর্ডার করে রাখলে তিনি সেদ্ধ করে রাখেন।

বিশেষজ্ঞরা কাঁচা খেজুরের রস পান থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দিয়েছেন, কারণ এটি নিপাহ ভাইরাসের সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। তাদের মতে, রস সংগ্রহের পর ৭০-৮০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় সেদ্ধ করলে ভাইরাস ধ্বংস হয়ে যায়। স্বাস্থ্যঝুঁকি এড়াতে কাঁচা রস পান না করে সেদ্ধ করা রস পান করাই নিরাপদ। তাছাড়া, খেজুরের রস সংগ্রহের সময় সঠিক নিয়ম ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা মেনে তা সংগ্রহ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বস্ত উৎস থেকে রস সংগ্রহ করাই সবচেয়ে নিরাপদ এবং স্বাস্থ্যসম্মত।

বিষ্ণুপুরে শুধু সেলিম শাহ নয়, তার মতো আরও ১০-১২টি পরিবার খেজুরের রস সংগ্রহ ও বিক্রির সঙ্গে যুক্ত। এটি তাদের পরিবারের জন্য একটি বাড়তি আয়ের উৎস। সেলিম শাহ বলেন, “এই মৌসুমে রস আর গুড় বিক্রি করে যে টাকা পাই, তা দিয় ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা থেকে শুরু করে বিশেষ প্রয়োজনীয় খরচ মেটাই। শীতকাল আমাদের জন্য আশীর্বাদ।”

 

সকাল গড়াতে থাকে, বিষ্ণুপুরে মানুষজনের আনাগোনা বাড়তে থাকে। প্রবাসী মাইনুদ্দিন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার উলচা পাড়া থেকে ১৪ জন বন্ধুকে নিয় এসেছেন, বলেন, “শীতে আসতে একটু কষ্ট হয়েছে ঠিকই, কিন্তু এখানে এসে যে অভিজ্ঞতা পেলাম, তা স্মৃতির পাতায় ধরে রাখার মতো। বন্ধুদের সঙ্গে কাটানো এই সময়টি সত্যিই অসাধারণ।”
মেহেদি হাসান নামের আরেকজন বলেন, “এখানে না এলে জানতামই না শীতের সকাল এত সুন্দর হতে পারে। খেজুরের রসের স্বাদ একেবারেই আলাদা।”

ইমরুল নিজের হাতে খেজুর গাছ থেকে হাঁড়ি নামিয়ে রস খেয়েছেন, বলেন, “এমন অভিজ্ঞতা জীবনে খুব কমই আসে। নিজের হাতে গাছ থেকে রস নামিয় খাওয়ার আনন্দ সত্যিই অন্য রকম।”
আকরাম যোগ করেন, “শহরে বসে আমরা গ্রামীণ জীবনের এই স্বাদ কখনোই পাই না। আজ এখানে এসে গ্রামীণ শীতের সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারলাম।”

বিষ্ণুপুর গ্রাম শুধুমাত্র খেজুরের রসের জন্য বিখ্যাত নয়, এটি শীতের সকালের অপরূপ সৌন্দর্যেও আকর্ষণীয়। কুয়াশায় মোড়া গাছগাছালি, পাখির কলকাকলি, আর খেজুর গাছ থেকে সংগ্রহ করা মিষ্টি রসÑসবকিছু মিলিয়ে বিষ্ণুপুর যেন এক রূপকথার গ্রাম।

 

আপনার মন্তব্য লিখুন

আর্কাইভ

May 2025
M T W T F S S
 1234
567891011
12131415161718
19202122232425
262728293031  
আরও পড়ুন
অনুবাদ করুন »