স্মৃতিকথা——জাহাঙ্গীর আলম বিপ্লব
বার্তা সম্পাদক প্রকাশিত: ৮:২১ অপরাহ্ণ , ১৯ জুলাই ২০১৯, শুক্রবার , পোষ্ট করা হয়েছে 5 years আগেছোটবেলায় মাটির খুব কাছাকাছি ছিলাম। ফেলে এসেছি ওই লাল-সবুজ মরিচের ক্ষেত, রাস্তার মোড়ে বটবৃক্ষ। তখন আমাদের সামনে পুকুর ছিল, বাগান ছিল আর ছিল মাটি । এখন মানুষ এই মাটির থেকে অনেক দূরে সরে এসেছি । আমার গল্প মানেই ঝকঝকে রূপালি নদী,সবুজে মোড়াদিগন্ত বিস্তারী মাঠ,সোনালী ধানের মুল্লুকও কবরস্থান,শ্মশানের বটগাছ আর রেললাইন সঙ্গে আমার নাড়ি নক্ষত্রের যোগ । আমার স্মৃতির শুরুও সেখান থেকে । আমি ক্ষুদ্র ব্যক্তি, বিশিষ্ট কেউ নই । আমার জীবনও এতটা বর্ণাঢ্য নয়। যা ব্যক্তিগত তাই সামষ্টিক, আমার বয়সের সঙ্গে বদলে যাওয়া সমাজ, সমাজ মানস, পরিসর ও পৃথিবী আমার লেখার বিষয় । যদি আমার দেখা পৃথিবীর খানিকটাও তুলে ধরতে পারি তাতেই আমার লেখার সার্থকতা।
অনেক দিন আগের কথা, তখন ফেসবুক ছিল না, এত এত টেলিভিশন ছিল না । সেই সময়ের ব্র|হ্মণব|ড়িয়| ছিল নিরিবিলি, ছিমছাম । চলাচল রিক্সাতেই । গরুর গাড়ির সংখ্যা তখন হ্রস্বমান । একবারই চড়ে ছিলাম,মনে আছে । প্রাইভেট কার হাতে গোনা । বাড়িতে ফিলিপস বাতি টিমটিমে জ্বলে। আমার ছেলেবেলার ব্র|হ্মণব|ড়িয়| একধরনের শান্ত শ্রী শহর ছিল। সেটা মফস্বলি নয়,বরং ঢিমেতালে চলা শহর,কিন্তু তাতে একধরনের স্মার্টনেস ছিল। সবার কেমন মমত্ব ছিল শহরটাকে ঘিরে। শহরটাও যেন সেটা বুঝে সাড়া দিতো । নানা ধর্ম, জাতি, পেশা, বর্ণ মিলিয়ে একটা অন্য রকম ঘ্রাণ। আজকের বখাটে ব্র|হ্মণব|ড়িয়|র অপরিকল্পিত নগরায়ন আর জঞ্জালের ভীড়ে সেই রূপ আর প্রাণ খুঁজেও পাওয়া যাবে না। কত গল্প যে জমা হয়েছে, গর্ভবতী মেঘের মতো ফুলে ফেঁপে এবার তৈরী ঝরার জন্য । সীমিত জ্ঞান আর পরিসর মাপা, তাই অল্প অল্প করে বললেই হবে।
বাড়ির মানুষেরা বাংলা সন তারিখে অভ্যস্ত । তারা বলতেন, আশ্বিন মাসে বোনের বিয়ে,ভাদ্র মাসের গরমে তাল পাকে মাঘ মাসে বাড়ি যাবো । বাংলা মাসগুলো ওনাদের কাছে শুনে শুনে শেখা । তখনকার দিনেপহেলা বৈশাখ এমন ঘটা করে হতো না । ছুটি তো দূরের কথা । ইলিশ নিয়ে মাতামাতি নেই, নতুন কাপড় নেই, আড়ম্বর নেই, তবুও নতুন বছর বাঙালী বলে কথা । বাংলা বছরের আরম্ভ । হাল খাতা হতো ব্যবসায়ীদের দোকানে দোকানে । আমরা অপেক্ষায় থাকি বাবার বন্ধুরা কখন মাটির হাড়িতে রসগোল্লা, পান্তোয়া বাতাসা, মুন্ডা, জিলাপি, মুড়ি, মুড়কি,নিয়ে আসবে । ব্যবসার নতুন খাতা খোলা হয়েছে, তার জন্য এত আয়োজন । হিন্দু মুসলিম খৃষ্টান বৌদ্ধ, বাঙালী অবাঙ্গালী, সব রকম অভিজ্ঞতা নিয়ে জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় রচিত হয় ।
হিন্দু মুসলিম সম্প্রীতিতে আমাদের তখনো অগাধ বিশ্বাস । পূজা মানেই ঢাকের আওয়াজ, মাইকে গান । সেই বয়সে কার কি বিশ্বাস, ধর্ম কি,আলাদা করে বোঝার প্রয়োজন পড়েনি । কিন্তু সে সুখ খুব বেশি দিন আর অটুট থাকেনি । সেটা খুব বড়জোর আর কয়েক বছর ধরে রাখতে পেরে ছিলেম। ছবির মতো সুন্দর আমাদের কুমোর পাড়ার সব বাড়িই ছিল হিন্দু মালিকানাধীন । এক দশকেৱ মধ্যেই নোংরা পুঁজিবাদের পূঁজের নীচে সব ঢাকা পড়ে গেছে । এপারের মানুষেরা ওপারে গেছেন, জলের দরে হিন্দু জনগোষ্ঠী ভিটেবাড়ি বেনিয়াদের হাতে তুলে দিয়ে দেশ ছেড়েছেন। ফলে অনেক বাড়িতে উঠোনে তুলশীমঞ্চ এখনো দৃশ্যমান । আমাদের বাড়ির পেছেনের বাড়িতে উত্তমবাবু ছেলেমেয়েরা ভারতে পাড়ি দিলেও, তিনি রয়ে গেছেন স্ত্রী আর পরিপাটি সংসার সামলে।
আমি যখন তিন চাকার সাইকেলে উঠোনময় ঘুরে বেড়াই, শিশু মনে সে সবও রেখাপাত করে। এরই মধ্যে কাঠের ফ্রেমের গ্রানাইটের স্লেট আমার ছোট্ট জীবনে অভিনব সংযোজন । তাতে ফুল পাখি আঁকা শিখি । খাতা আসে, সঙ্গে রং পেন্সিল । আমরা শিশুরা আনন্দটাই বুঝতাম, আর কিছু তো বোঝার ছিলো না । সবরকম স্বাদ, সান্নিধ্যের মাঝে বড় হওয়া। জীবন যে গল্প উপন্যাসের চেয়ে বিচিত্র,এটুকুন বুঝেছিলাম ।
নিউজিল্যান্ডের ব্যাপ্টিস্ট খ্রিস্টান কর্তৃক পরিচালিত মিশন প্রাইমারি স্কুল । সেটা তখন শহরের সেরা স্কুল বলে গণ্য । মোড়াইলের বিশাল এলাকা জুড়ে সুরক্ষিত দেয়াল ঘেরা গথিক স্থাপত্যের স্কুল এবং হাসপাতাল। সাদা চামড়ার মেমদের আবাসস্থান ছিল তাই মেমের কুঠি নামে সবাই চিনত৷ চার্জেৱ দেয়ালে ক্রুশবিদ্ধ যিশুর রক্তাক্ত মূর্তি। তারপর হাসপাতাল গেট আর করিডোর পেরিয়ে এক বিরাটকায় স্কুল রাজ্য । এখানেই পরবর্তী ছয়টা বছর কাটে ।
আমাকে সেখানেই পাঠানোর সিদ্ধান্ত হলো । মেমেদের ভয়ে নাকের জলে চোখের জলে ভেসে শিশুশ্রেণিতে ভর্তি হওয়া । কখন জসীম ভাই বাজাবে সেই ঘন্টা আর কখনই ছুটি হবে চোখ থাকে গেটের দিকে, কখন আমাকে কেউ নিতে আসবে। সাদা চামড়ার জোছনা দিদি ক্লাস নেন। ক্লাস সময় ধরে চলে। ক্লাসে পাতার পর পাতা অক্ষর লেখাতো, ওটাই বানান ভুল হতে দিতো না । মা আমার হোম ওয়ার্কের দায়িত্বে, স্কুলে যতটুকু পড়া দেয়, তার অধিক মা করিয়ে ছাড়ে । একটু বেশিই কড়াকড়ি । একটু দেরী বা নিয়ম ভঙ্গে শাস্তি, অভিভাবকদের তলব । মায়েরা গর্বের সঙ্গে সেই স্কুলের গল্প করেন। ভিষণ নিরানন্দ ক্লাস শেষে বাড়ি ফেরার জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকতাম । কিছুদিনেই মন বসে গেলো । আমি নতুন সাথী পেয়ে গেলাম । সেই প্রথম আমি স্কুলের মজা পেলাম । আমি বাংলা ভালোবাসলাম। যেন সেখানে অনাবিল সুখ । এই বিদ্যালয়ের সঙ্গে ওতোপ্রোতো জড়িয়ে আছে রেনু (বড়দিদি) জোছনা দিদির নাম এবং তাদের অক্লান্ত পরিশ্রম । অভাব দিদিদের (শিক্ষক) সেই পরিসরের, যা অনুশীলিত শিক্ষক হবার প্রাথমিক শর্ত । আমরা মিশন স্কুলের প্রাক্তন শিক্ষার্থী হয়ে সেই অভাবটা বড্ড তীব্রভাবে অনুভব করছি এই সময়ে। নিজেকে বিলিয়ে অন্যকে সুখী রাখার প্রয়াসে নিজেকে প্রস্ফুটিত করে আবার ঝরে গিয়েও সম্ভাবনাময় আগামী রেখে গেছেন৷
আপনার মন্তব্য লিখুন