যে কারণে খুন হলো কলেজছাত্র ইকরাম !
বার্তা সম্পাদক প্রকাশিত: ৭:১৭ অপরাহ্ণ , ১৩ আগস্ট ২০১৯, মঙ্গলবার , পোষ্ট করা হয়েছে 6 years আগে
এদিকে এই খুন সংঘটিত হওয়ার পর থেকে বিরামহীন তদন্ত কাজ শেষে সোমবার সন্ধ্যায় ওসি সাহাদাত হোসেন এক প্রেস ব্রিফিং এর মাধ্যমে এ হত্যাকাণ্ডের রহস্য উন্মোচন করেন।
যে কারণে এ খুন :
কালিকচ্ছ বারজীবিপাড়ার সহিদুল ইসলামের ছেলে ইকরাম হোসেন। তার বাবা নোয়াগাঁও ইউপির চৌরাগোদা গ্রামের এক মসজিদের ইমাম। ইকরাম তার বাড়ির পাশেই ভগ্নিপতি প্রবাসী বাহার উদ্দিনের বাড়িতে থেকে পড়ালেখা করতেন। ইকরামের ভাগ্নি সুমাইয়া আক্তার সিমুকে স্কুলে আসা-যাওয়ার পথে উত্যক্ত করতো বারজীবিপাড়ার রবিউল্লাহ’র ছেলে মো. শিমুল। বিষয়টি নিয়ে স্কুলছাত্রী সিমুর মা লাভলী বেগম ও মামা ইকরাম হোসেন প্রতিবাদ করেন। এ নিয়ে ইকরাম ও শিমুলের মধ্যে একদিন হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। এক পর্যায়ে শিমুল বেপরোয়া হয়ে স্কুলছাত্রী সিমুর গায়ে হাত দেন। এতে লাভলী বেগম সরাইল থানায় অভিযোগ করলে পুলিশ শিমুলকে ইভটিজিং এর অপরাধে ২০১৮ সালের ১৩ অক্টোবর গ্রেফতার করে উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট উম্মে ইসরাত এর ভ্রাম্যমাণ আদালতে হাজির করেন। তখন আদালতে এ ইভটিজিং এর ঘটনার সাক্ষ্য দেন ইকরাম। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট শিমুলকে আট মাসের বিনাশ্রম কারাদন্ড প্রদান করেন। সেই সময়ে আসামি শিমুল হুমকি দেন জেল থেকে ছাড়া পেয়ে এসে ইকরাম ও তার বাবাকে খুন করবে। এদিকে ইভটিজিং এর অপরাধে শিমুল গ্রেফতার হওয়ার পর নাজমা বেগম ও তার ভাই নাজিম উদ্দিন ইভটিজার শিমুলের পক্ষ নেন। তারা শিমুলকে ছাড়িয়ে নিতে জোর চেষ্টা তদবির চালিয়ে ব্যর্থ হন। পরে তারা ইকরাম ও তার বাবার ওপর ক্ষিপ্ত হন এবং হুমকি দেন শিমুল জেল থেকে আসার পর এ ঘটনার জন্য চরম খেসারত দিতে হবে। এরমধ্যে সুমাইয়া আক্তার সিমুকে অন্যত্র বিয়ে দেন তার পরিবার। এসব নিয়ে নাজিম উদ্দিন ও নাজমা বেগম প্রায়ই নানাভাবে চাপে রাখতেন ইকরাম ও তার ভাগ্নি সিমুর পরিবারকে।
খুনের পরিকল্পনা হয় যেভাবে :
ইভটিজিং এর অপরাধে টানা আট মাস জেল খেটে শিমুল গত দুই-আড়াই মাস আগে কারাগার থেকে ছাড়া পান। এসে দেখেন সিমু এখন অন্যের স্ত্রী। সিমুর জন্যে তার জেল হয়েছে, তাই সিমুকে যেকোনো মূল্যে তাকে পেতে হবে। সিমুর পরিবারকে ধ্বংস করতে হবে। এমন চ্যালেঞ্জ মাথায় নেন শিমুল। এতে শিমুলের পাশে থেকে যেকোনো সহায়তা করার পূর্ণ আশ্বাস দেন সাবেক ইউপি সদস্য নাজিম উদ্দিন ও নাজমা বেগম। কারণ নাজমা বেগমের সঙ্গে সুসম্পর্ক রয়েছেন এখানকার বড় বড় জনপ্রতিনিধি ও রাজনৈতিক কিছু নেতার। কিন্ত এতে বাধা কলেজছাত্র ইকরাম হোসেন। কারণ সিমুর বাবা বাহার উদ্দিন বিদেশে, তাদের পরিবারে একমাত্র পুরুষ ইকরাম।
তখন শিমুল ও তার সহায়তাকারীরা পরিকল্পনা করেন ‘যেভাবেই হউক ইকরামকে সরিয়ে ফেলতে হবে’। তারা অপেক্ষায় থাকেন একটি ভালো সময়ের। আর খুঁজতে থাকেন ইকরামের দূর্বল কিছু। সম্প্রতি তারা পেয়ে যান ইকরামের সম্পর্কের ভাগিনা সরাইল সদরের বড্ডাপাড়া গ্রামের মজনু মিয়ার ছেলে সাদীকে। তারা সাদীকে ‘ঢাল’ হিসেবে ব্যবহার করতে তার সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলে। সাদী মাঝেমধ্যে খালা লাভলী বেগমের বাড়িতে আসতো। রাত্রিযাপন করতো মামা ইকরামের ঘরেই। সাদী ও ইকরাম সম্পর্কে মামা-ভাগিনা হলেও একসঙ্গে চলাফেরা করতো বন্ধুর মতো। তারা বিভিন্ন সময় নানা স্থানে গিয়ে একসঙ্গে ছবিও তোলেন। তবে কিছু কিছু বিষয় নিয়ে ইকরাম চড়-থাপ্পড় দিতো সাদীকে। সাদী সম্পর্কে ভাগিনা হলেও মামা ইকরামের চেয়ে সে বয়সে বড়। এতে সে ক্ষুব্ধ হতো ইকরামের ওপর। এই সুযোগটা কাজে লাগিয়ে শিমুল ও তার সহযোগিরা সাদীকে বশে আনেন। তারা নানা কুপরামর্শ দিয়ে ইকরামের ওপর সাদীকে আরও ক্ষিপ্ত করে তোলেন।
যেভাবে খুন করা হয় ইকরামকে :
শনিবার (১০ আগস্ট) সাদী তার খালা লাভলী বেগমের বাড়িতে বেড়াতে আসে। পূর্বের ন্যায় রাতের খাবার শেষে সাদী তার মামা ইকরামের ঘরে ঘুমাইতে যায়। রাত এগারোটায় দিকে তারা মামা-ভাগিনা একসঙ্গে আম খায়। রাত অনুমান ১২টার দিকে ইকরামের মোবাইলে ফোন আসলে সে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। কিছুক্ষণ পর সাদীও ঘর থেকে বেরিয়ে পাশেই শিমুলের ব্রয়লার ফার্মে যায়। সেখানে আগে থেকেই শিমুল ও তার সহযোগী সোহাগ অপেক্ষা করছিল। তখন শিমুল সাদীকে জানাই আজ ইকরামকে মেরে ফেলবো, ঘরে দরজা খুলা রাখিস। তখন সাদী বলে ‘একেবারে মারার দরকার নাই, হাত-পা ভেঙে দিলেই হবে’। সাদী ঘরে ফিরে আসে। রাত অনুমান দেড়’টার দিকে ইকরাম ঘরে ফিরে বিছানায় ঘুমিয়ে পড়ে। তখন সাদী পাশে সোফায় শুয়ে মোবাইলে ভিডিও দেখছিল। কিছু সময় পর বস্তা ও ছুরি নিয়ে শিমুল ও সোহাগ এ ঘরে প্রবেশ করে। “তখন সাদী ঘুমন্ত মামা ইকরামের দুই পা চেপে ধরে, সোহাগ দুই হাত চেপে ধরে ও শিমুল ঘরে থাকা বটি দা দিয়ে প্রথমে ইকরামের গলা কাটে, পরে ছুরি দিয়ে শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাত করে ইকরামের মৃত্যু নিশ্চিত করে। তারা লাশটি বস্তাবন্দি করে অন্যত্র গায়েব করার চেষ্টা করে। কিন্তু ভোর হয়ে যাওয়ায় ইকরামের লাশ বস্তাবন্দি অবস্থায় ঘরে খাটের নিচে ফেলে রেখেই তারা চলে যায়। লাশের রক্ত পরিস্কার করার পর তারা রক্ত মাখা বিছানার ছাদর লুকানোর চেষ্টা করে।
যেভাবে এ খুনের রহস্য উন্মোচন হলো :
রোববার (১১ আগস্ট) সকালে উপজেলার কালিকচ্ছ বারজীবিপাড়ার এক বাড়িতে খাটের নিচে বস্তাবন্দি লাশের খবরে সেখানে ছুটে যান সরাইল থানার ওসি’র নেতৃত্বে পুলিশের একটি টিম, সরাইল সার্কেল এর সহকারি পুলিশ সুপার মো. মকবুল হোসেন ও জেলা সদর থেকে আসেন পিবিআই পুলিশের একটি টিম। এসময় আশপাশের হাজার হাজার মানুষ সেখানে ভীড় জমান। পরদিন ঈদ, এই ভেবে পুলিশ তাদের তদন্তের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে দ্রুত লাশের ময়নাতদন্তের ব্যবস্থা করেন।
এদিকে এ খুনের ব্যাপারে কেউ কিছু বলছে না। পুলিশও এর কূলকিনারা খুঁজে পাচ্ছে না। হঠাৎ ওসি সাহাদাত হোসেনের কানে খবর এলো গতরাতে ইকরামের সঙ্গে এই ঘরে তার ভাগিনা সাদী ঘুমিয়ে ছিল, এখন তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। লাশ নেওয়া হলো মর্গে। মানুষের ভীড় কমতে থাকলো। তখন নিহতের পরিবারের লোকজন ও আশপাশের মানুষ বলাবলি শুরু করেন নিহত ইকরামের সঙ্গে শিমুল, নাজমা বেগম ও নাজিম উদ্দিনের বিরোধের কথা। তখন পুলিশ নাজমা ও তার ভাই নাজিম উদ্দিনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পাশেই তাদের বাড়ি থেকে আটক করে থানায় নিয়ে আসে। কিছু সময় পর ওসি সাহাদাত হোসেন ফের ঘটনাস্থলে যান এবং সাদীকে খোঁজ করেন। কেউ তার অবস্থান নিশ্চিত করতে পারেননি। তখন ওসি কৌশল খাটিয়ে সাদীর স্বজনদের সঙ্গে ভিন্ন আলোচনায় জড়ান। একপর্যায়ে সাদী তার নানার বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে। এসময় তার পরিহিত প্যান্টে রক্তের ছাপ দেখতে পায় পুলিশ। ওসি কৌশলে নানা কথা বলে সাদীকে সঙ্গে করে থানায় নিয়ে আসে। থানায় এসেই সাদী তার প্যান্টে মাখা রক্ত পানি দিয়ে ধূয়ে ফেলে।
এদিকে রোববার দুপুরের দিকে সাদীকে থানায় দেখেই নাজমা বেগম ডিউটি অফিসারের রুম থেকে কৌশলে কর্তব্যরত পুলিশ সদস্যদের ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে গিয়ে থানা কমপ্লেক্সের পাশেই ছোট দেওয়ানপাড়া এলাকায় এক বাড়িতে আশ্রয় নেন। থানা থেকে পালিয়ে গিয়ে নাজমা প্রথমেই ঘাতক শিমুলকে ফোন দেন। তার পালিয়ে আসার বিষয়টি জানিয়ে শিমুলকে নিরাপদে আশ্রয় নেওয়ার পরামর্শ দেন নাজমা। সাদী পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়েছে, শিমুলকে এ খবর জানিয়ে নাজমা তার জন্য নিরাপদ আশ্রয়ের সহযোগিতাও চান শিমুলের কাছে। এরকিছু সময় পর পুলিশ তথ্যপ্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে নাজমাকে সেই বাড়ি থেকে ফের আটক করে থানায় নিয়ে আসে। পরে পুলিশের ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদে রোববার দিবাগত রাত ৩টার দিকে সাদী এ খুনের সকল ঘটনা পুলিশের কাছে খুলে বলে।
সোমবার (১২ আগস্ট) আদালতে সাদী বিচারকের কাছে এ খুনের ব্যাপারে জবানবন্দি দেয়। এ ঘটনায় নিহতের বাবা বাদী হয়ে থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেছেন। মামলায় শিমুল, সাদী, সোহাগ, নাজিম উদ্দিন ও নাজমাকে আসামি করা হয়েছে। এদের মধ্যে শিমুল ও সোহাগ পলাতক রয়েছে। বাকিরা জেলহাজতে আছে।
আপনার মন্তব্য লিখুন