নতুন মাত্রা পত্রিকার অনলাইন ভার্সন (পরীক্ষামূলক সম্প্রচার)

 ঢাকা      রবিবার ১১ই মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ২৮শে বৈশাখ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

ঈদ আনন্দে শোকে লজ্জায় পাথর পিতা — আল আমীন শাহীন

বার্তা সম্পাদক

প্রকাশিত: ১১:০১ পূর্বাহ্ণ , ২৮ জুন ২০২৩, বুধবার , পোষ্ট করা হয়েছে 2 years আগে

ঈদ উপলক্ষে ব্যতিব্যস্ততা সর্বত্র। উঠতি যুবকদের মাঝে বেশ উদ্দীপনা। কোরবাণীর পশুর হাটে তাদের সংখ্যায়ই বেশী। অন্তর রহমান পেশাগত কাজেই যাচ্ছেন গরুর হাটে। নতুন নতুন ঘটনা ঘটছে। এর মধ্যেগরুর ওজন এবার হচ্ছে স্কেলে আস্ত গরু কেজি হিসেবে বিক্রি হচ্ছে। মূল্য নির্ধারিত। ঠকে যাবার আশংকা কম। মহাসড়কে খুব ভীর। জ্যামে আটকা পড়ে অন্তর দেখছেন। একদল ছেলে মোটরসাইকেল বহর নিয়ে হৈ হোল্লার করে ছুটছে। মাথায় হেল মেট নেই, এক সাইকেলে আরোহী তিনজন। চালনায় উন্মাদনা। অন্তর ভাবছে আহারে উঠতি সময়। কিছু ক্ষণ পরেই বাজারের কাছাকাছি গিয়ে অন্তর রহমান দেখলো মানুষের জটলা। ২ টি ছেলে পড়ে আছে রাস্তায় রক্তাক্ত, ক্ষত বিক্ষত। একে অপরের পাশাপশি। সাথে দামী মোটর সাইকেল দুমড়ে মুচড়ে গেছে। ১ ছেলের শরীর থেকে পা বিচ্ছিন্ন। অপর জনের মাথা থ্যাথলানো। চেহারা চেনার উপায় নেই। কেউ চেনেনা,তারা কারা। মৃত ভেবে কেউ ধরছে না তাদের। মানুষের ভীর বাড়ছে। সবাই নিশ্চুপ হয়ে দেখছে, কেউ ধরছে না তাদের। ভয় পাচ্ছে অনেকে। দূর্ঘটনার খবরে ছুটে এলো পুলিশের গাড়ি। হতাহতদের হাসপাতালে নেয়ার তাড়া। গাড়ি ঘুরিয়ে অন্তর এলন হাসপাতালে।
চিকিৎসক জানাল, প্রাণ নেই। ২টি লাশ, পরিচয় জানা যায়নি তখন তাদের। লাশ যারা দেখছে তাদের আফসোস, বলাবলি,“না জানি কার বুকের ধন।” তরতাজা দুটি প্রাণের অকাল করুণ মৃত্যুতে ব্যথিত দর্শনার্থীরা। পরিচয় জানতে পকেট থাকা জিনিষ খুঁজতেই একজনের পকেটে পাওয়া গেল ২ বোতল ফেন্সিডিল। তাৎক্ষণিক দাঁড়িয়ে থাকা দর্শকরা মন্তব্য করতে লাগলো,“ও ফেন্সিখোর”। দূঘটনায় করুণ মৃত্যু অনেকে ছুটে আসছেন দেখতে, এসেই প্রশ্ন ওরা কারা। দর্শকদের উত্তর- “ফেন্সিখোর মরেছে।” তাদের কাছে পাওয়া মোবাইলের কল লিস্ট দেখে দেখে খোঁজ খবর শুরু হলো । সাংবাদিক ছবি তুলছে। আশপাশের লোকজনকে জিজ্ঞাস করতেই উত্তর “তারা ফেন্সিখোর।” এ কেমন পরিচয়। দুটি মৃতদেহেরই বয়স ২০ এর নীচে। বেশ ভ’ষায় বোঝা যায় ধনী পরিবারের সন্তান। লেখাপড়া করে, তা চেহারার ফুটে উঠে। কলেজ পড়–য়া হতে পারে। কিন্তু তাদের প্রাথমিক পরিচয় এখন “ফেন্সিখোর ।” এরি মাঝে নিহতদের আত্মীয় স্বজনের খোঁজ পাওয়া শুরু হলো। পরে জানা গেল তারা ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নয়। বাইরের জেলার । একজনের বাবা সরকারী কর্মকর্তা অপরজন বড় এক ব্যবসায়ীর ছেলে। দুজনই কলেজ পড়–য়া , ছাত্র হিসেবেও মেধাবী, অথচ নিহতদের শেষ পরিচয় হলো “ ফেন্সিখোর” হিসেবে। প্রায় ৩ ঘন্টা পর হাসপাতালে শুরু হলো নিহতদের আত্মীয় স্বজনের আসা । হাসপাতালে কান্নার রোল, বিলাপ। লাশ ঘরের অদূরে দেখি একজন দাঁড়িয়ে, নির্বাক। আশপাশের সবাই বল্ল, উনি একজনের পিতা । পুত্রহারা এ পিতা কোনভাবে মেনে নিতে পারছেনা তার পুত্রের করুণ মৃত্যু। কিভাবে হলো সে প্রশ্নও করতে পারছে না কারো কাছে। কেননা সবাই বলাবলি করছিল “দুটি ফেন্সিখোর মরেছে” তাদের পকেটে ফেন্সিডিলের বোতল পাওয়া গেছে। ফেন্সিডিল খেতে এসে তারা মারা গেছে। এইসব কথায় নির্বাক গেছে এ মানুষটি। সব শুনে শোকে আর লজ্জায় এ পিতা পাথর হয়ে গেছে।
অন্তর ভাবছে , হাসপাতালে প্রায়শই উঠতি মোটর সাইকেল চালকরা হতাহত হয়ে আসে। পত্রিকার শিরোনাম হয় “সড়ক দূঘটনায় মোটরসাইকেল আরোহী নিহত অথবা আহত। এক সাইকেলে ২ আরোহী ৩ আরোহী। তাদের চালনা ভাব এবং আচরণ দেখলেই বোঝা যায় তাদের যাতায়াতের উদ্দেশ্য। মহাসড়কে একে অপরের সঙ্গে গতির প্রতিযোগিতা দিয়ে তারা চলে। তাদের অনেকের পিতা থাকে প্রবাসে। কস্টার্জিত টাকা পাঠায় দেশে। আর সে টাকায় ক্রয় হয় হাল ফ্যাশনের মোটর সাইকেল। শো রুম থেকে কিনে গাড়ী নিয়ে নামে সড়ক মহা সড়কে, অধিকাংশরই ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই। আত্মঘাতি সৌখিনতায় তারা নেমে পড়ে পথে। জুটিয়ে নেয় তাদেরই মতো বন্ধু বান্ধব। এই বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তারা টাকা খরচ করে দেদারসে নানা অপকর্মে। উঠতি বয়সী এসব ফেন্সি আসক্তদের প্রতিদিনের খরচ কারো ১ হাজার কারো ২ হাজার। মাসে ৩০/৪০ হাজার টাকা কারো কারো। ভাল চাকুরীজীবিদের মাসে যা বেতন তা থেকে এসব সন্তানদের খরচ বেশী। প্রথমে পরিবার থেকে নানা আবদার অনুরোধ অজুহাতে। পরে মিথ্যা নানা কথায় , নিজ ঘরে চুরি করে করে অর্থের জোগান। শেষে অনেকে অসৎ পথে গিয়ে চুরি ডাকাতি ছিনতাই অপহরণ খুন ইত্যাদী তে জড়িয়ে পড়ে। পুলিশের হাতে ধরা পড়ে এক সময় অনেকে যায় জেলা হাজতে আসামী অপরাধী হয়ে। সুন্দর সুঠাম দেহের তরুণ যবারা বিবর্ণ হয়ে একসময় অনেকে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। সময় মতো প্রতিরোধ না করতে পেরে অনেক পরিবারেÍ অভিভাবকরা হয়ে পড়ে অপরাধী পুত্রের কাছে অসহায়। র্দূভাগা নির্বাক অনেক পিতাকে কাঁধে নিতে হয় পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ভারী পুত্রের কফিন। আর পুত্র হারা মায়ের শুরু হয় সারা জীবনের জন্য পুত্র হারার শোক মাতম, কান্না আহাজারী আর দীর্ঘশ্বাস। আত্মঘাতি সৌখিনতার জন্য দেয়া মোটর সাইকেল অথবা প্রয়োজনের বাইরে খরচের জন্য অতিরিক্ত টাকা দেয়ায় মা বাবা হয়ে উঠেন নিজের কাছেই অপরাধী।
অন্তর ভাবনা কাটিয়ে সেই শোকাহত বাবার পাশে গিয়ে দাঁড়াল, সেও পাথর কোন সান্ত¦ না দিতে পারলো না।
এমন ঘটনা ঘটছে তবে তা রোধ কর্ওা সম্ভব। সৌখিনতায় মত্ত হয় এমন তরুণ যুবার পরিবারের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে ঠিকই তবে মোট জনসংখ্যার তুলনায় এখনও তা অনেক কম। প্রতিটি পরিবারে মহল্লায় বখে যাওয়া সন্তান যারা তাদের এখনও চিহ্নিত করা যায়। পারিবারিক খবর দারি, তদারকী, খোজ খবর নেয়া সহ সামাজিক উদ্যোগ সর্তকতা আর সচেতনতায় তাদেরকে ফেরানো যায় মৃত্যুর পথ থেকে। বেওয়ারিশ লাশ হওয়া থেকে, মহাসড়কে খন্ডিত রক্তাক্ত লাশ হওয়া অথবা চিরপঙ্গু হওয়া থেকে। লেখার শুরুর মোটর সাইকেল আরোহীর পিতার মতো কারো ভাগ্য যেন না হয়। কাউকে যেন পুত্রের লাশের সামনে শোকে লজ্জায় পাথর না হতে হয় সে ব্যাপারে সচেতন হওয়া দরকার ঘটনার ঘটার আগেই।

লেখকঃ সম্পাদক, সাপ্তাহিক নতুনমাত্রা, সাবেক ভারপ্রাপ্ত সভাপতি, ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রেস ক্লাব, সহ সভাপতি ব্রাহ্মণবাড়িয়া টেলিভিশন জার্নালিস্ট এসোসিয়েশন

আপনার মন্তব্য লিখুন

আর্কাইভ

May 2025
M T W T F S S
 1234
567891011
12131415161718
19202122232425
262728293031  
আরও পড়ুন
অনুবাদ করুন »